রহস্যের কেন্দ্রে সেই নারী

মাওলানা ফারুকী হত্যার রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে এক নারীকে ঘিরে। হত্যাকাণ্ডের কিছু সময় আগে তিনি ফারুকীর সঙ্গে দেখা করে যান। পুলিশের হেফাজতে থাকা রোরখা পরা ওই নারীর বক্তব্যে যেমন অসংগতি তেমনি তার ব্যাপারে ফারুকীর পরিবারের ভাষ্য পুরো ঘটনাকে রহস্যময় করে তুলছে। কে এই রহস্যময়ী?

ফারুকী2

রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বসবাস করতেন ইসলামী ফ্রন্ট নেতা ও টেলিভিশনে ইসলামি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা শায়খ নূরুল ইসলাম ফারুকী। সেখানকার বসার ঘরটি ছিল তার খণ্ডকালীন অফিস। ফারুকী ‘ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হজে লোক পাঠাতেন।

পেশাদার ইসলামি বক্তা হিসেবে টিভি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-মাহফিলেও যেতেন মাওলানা ফারুকী। এসব কাজের জন্য ভক্ত ও দোয়াপ্রার্থীরা তার বাসায়ও আসতেন। বিকেলে ও রাতে তিনি বসার ঘরেই অতিথিদের সঙ্গ দিতেন।

গত বুধবার রাতে সেখানেই খুনিদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এরপর খাবার ঘরে নিয়ে তাকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার তিন ঘণ্টা আগে এক ‘নারীভক্ত’ এসেছিলেন ফারুকীর কাছে। শুধু বসার ঘরে কথাবার্তা বলা নয়, তিনি ফারুকীর ঘরের প্রতিটি কোণা ঘুরে দেখেছেন। জীবনের অনেক সমস্যার কথা বললেও ফারুকীর কাছে তার আসার কারণ ছিল অস্পষ্ট। ফারুকীর স্বজনরা বলছেন, ওই নারীকে তারা চেনেন না।

এখন প্রশ্ন উঠেছে- খুনি চক্রের হয়ে অন্দরমহলের খোঁজ-খবর নিতে কি এসেছিলেন সেই নারী? নাকি কোনো পারিবারিক সমস্যার বিষয় আছে, যা গোপন করতে চাইছেন স্বজনরা?

তবে এসব প্রশ্নের অবসান হতে যাচ্ছে শিগগির। কারণ, সন্দেহভাজন ওই নারী এখন পুলিশের কব্জায়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নোয়াপাড়ার মুড়াপাড়া থেকে মাহমুদা আক্তার নামে ওই নারীকে আটক করা হয়। তার সঙ্গে শরিফুল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। এই দু’জনকে রাজধানীর মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এই নারীর আচরণ অত্যন্ত রহস্যজনক। প্রাথকিভাবে তার কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ফারুকী ও তার স্বজনদের কাছে তিনি নিজের নাম বলেছেন ‘আসমা’। আবার কেউ বলেছেন, তার নাম ‘আমেনা’।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বাংলামেইলকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের দিন বিকেলে ওই নারী (মাহমুদা) ফারুকীর বাসায় গিয়েছলেন। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন। তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। তার সঙ্গে শরিফুল নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।’

ডিবি পুলিশের ডিসি (পশ্চিম) নাজমুল আলম জানান, রহস্যজনকভাবে মাওলানা ফারুকীর বাসায় যাওয়ার কারণে ওই নারীকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। হত্যার মোটিভের ব্যাপারে তথ্য পেলে সংবাদ সম্মেলন করে তা প্রকাশ করা হবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের দিন বিকেল ৪টার দিকে ফারুকীর বাসায় যান এক নারী। তার পরিচয় ও কথাোর্তা নিয়েও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। তবে নারীর ব্যাপারে কিছুই জানে না বলে জানাচ্ছেন নিহতের স্বজনরা।

ফারুকীর স্ত্রী লুবনা জানান, ওই নারী তার নাম আসমা বলে জানান। একবার জানান তার বাড়ি বরিশাল। আবার বলেন রূপগঞ্জ। একবার ফারুকীকে বলেন সুন্দরবন থেকে এসেছেন তিনি। ওই নারী আসার আগে ফারুকীর কাছ থেকে মোবাইল ফোনে বাসার ঠিকানা নেন। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক সমস্যার কথা বললেও ওই নারী ফারুকীর কাছ থেকে টাকা নিতে রাজি হননি। পরে গুলিস্তানে যাওয়া কথা বলে বের হয়ে যান।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ফারুকীর বড় স্ত্রী মালিবাগে থাকেন বলে জানা গেছে। তবে তৃতীয় স্ত্রী আছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো সমস্যা আছে কি না এদিকটিও তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে।

ওই দিনের ঘটনার ব্যাপারে ফারুকীর ছোট স্ত্রী লুবনা যাকে নিয়ে তিনি থাকতেন, বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমি যখন তার জন্য খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে যাই। একটু পরেই মহিলা রান্না ঘরে ঢুকে পড়েন। তখন তাকে আমি বলি, খাবার প্রস্তুত হচ্ছে আপনি বসেন। কিন্তু আসমা নামের ওই মহিলা সেদিকে খেয়াল না করে আমাদের পরিবার সম্পর্কে নানা খোঁজখবর নিতে থাকেন। প্রতিটি কক্ষ তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন। আসমা ফারুকীকে বলেন, তিনি গভীর সমস্যায় পড়েছেন, তাকে দেখাশুনা করার কেউ নেই। তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, মোটা টাকা বেতন পান অথচ তাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয় না বলে জানান। আসমা নিজেকে ধার্মিক বলে পরিচয় দেন। অথচ মাগরিবের নামাজের সময় পার হলেও নামাজ পড়েননি।’

লুবনা জানান, আসমা ওইদিন রাতে থেকে যাওয়ার জন্য ফারুকীর কাছে বায়না করেন। কিন্তু তিনি তাতে সায় দেননি। ফারুকী তাকে কিছু টাকা দিতে চান। কিন্তু ওই নারী টাকা নিতে অস্বীকার করে জানান, তার কাছে তিন হাজার টাকা আছে। ঘরে ঢুকে আসমা অনবরত কথা বলেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাসা ত্যাগ করার সময় পুরনো বোরখা রেখে একটি নতুন বোরখা ব্যাগ থেকে বের করে পরেন।

লুবনা আরো জানান, বুধবার সন্ধ্যায় ওই নারী বাসা থেকে বের হওয়ার ১৫ মিনিট পরই দুই যুবক বাসায় আসেন এবং হজে যাওয়ার কথা বলে ফারুকীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। এদের মধ্যে একজনের মাথায় টুপি ও হালকা দাড়ি ছিল। এরপর আরও কয়েকজন যুবক বাসায় ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে। এরপর ফারুকীকে গলাকেটে হত্যা করে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ফারুকীর সঙ্গে মাহমুদা নামের ওই নারী দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোনে কথা বলেন। এরপর বাসায় গিয়ে রহস্যজনক আচরণ করেন। এর কিছু সময় পরই ফারকী খুন হন। এসব কারণে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মাহমুদার যোগসূত্র আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘প্রথম দুই দিনেই আমরা সন্দেহভাজন ৩০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় এই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হয়েছে। তবে তিনিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রহস্যজনক ক্যারেক্টার। ধর্মীয় ভিন্ন মতাদর্শীদের হুমকির বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া লুটের জন্য হত্যার পাশাপাশি তৃতীয় কোনো কারণে এই নারী হত্যাকাণ্ডে জড়িত কি না তাও খতিয়ে দেখা হেচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই নারী খুনি চক্রের পক্ষে রেকি (মিশনের আগে মাঠ পরিদর্শন) করতেও আসতে পারে। এছাড়া মাওলানা ফারুকীর ব্যক্তিগত জীবনের কোনো সমস্যার কারণে নারী এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে বলেও ধারণা পুলিশের।’

মন্তব্য