তার কারণেই চিরকুমার, তার শোকেই বিড়াল পোষা
ঢাবি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) মনিরুজ্জামান মিঞা। গত সোমবার রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান তিনি। তিনি রাষ্ট্রদূত এবং পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবেও দায়িত্বপালন করেছেন। ভূগোলবিদ হিসেবেও বেশ সুপরিচিত। এই মানুষটি ছিলেন অকৃতদার। কিন্তু চিরকৌমার্য বরণ স্বেচ্ছাকৃত নয়। এর পেছনে আছে এক মর্মান্তিক এবং অনবদ্য প্রেমের গল্প!
তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্র মনিরুজ্জামান মিঞা। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক উচ্ছ্বল তরুণ। প্রেমে পড়ে যান সহপাঠী এক হিন্দু মেয়ের। চুটিয়ে প্রেম করছিলেন তারা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবতেন নিজেদের। কিন্তু ধর্ম অলঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তাদের মাঝখানে। সমাজ স্বীকৃতি দেবে না- বাধ্য হয়ে এই ভয়ে পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন।
পরিকল্পনা ছিল নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে ট্রেনে করে রাজশাহী ছাড়বেন দুজনে। ওই নির্দিষ্ট দিনে রেলস্টেশনে হাজির প্রেমিকা। নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। অধীর আগ্রহে প্রাণের মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে মেয়েটি। ট্রেন চলে এসেছে। তখনও মনিরুজ্জামানের দেখা নেই। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ভুল বুঝতে শুরু করেন সবচে বিশ্বস্ত মানুষটিকেও। মনে করেন, মনিরুজ্জামান বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি মেয়েটি। ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পরপরই ঝাঁপ দিলেন। দু’টুকরো হয়ে ঘটনাস্থলেই ইহজগতের লীলা সাঙ্গ হলো তার।
এর মধ্যে প্রেমিক মনিরুজ্জামান হাঁপাতে হাঁপাতে স্টেশনে এসে পৌঁছান। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যান। দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে তারই প্রিয় মুখ। এই আফসোস সারাজীবনে আর গেল না, বিলম্ব করার সেই অপরাধবোধ তাড়িয়ে বেড়ালো তাকে। সিদ্ধান্ত নিলেন জীবনে আর কখনো বিয়ে করবেন না।
শুধু তা-ই নয়, প্রেমিকার স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবন কাটালেন তিনি। মেয়েটির শখ ছিল বিড়াল পোষা। সেই শখটাকেই আঁকড়ে ধরলেন। হ্যাঁ, মনিরুজ্জামানের পরবর্তী জীবনের অন্যতম সঙ্গী ছিল বিড়াল। ছোট্ট প্রাণিটার মধ্যেই যেন প্রেমিকা অনুভব করতেন প্রতিদিন।
তার এই বিড়াল পোষার গল্প জানা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের প্রবীণ নিরাপত্তা কর্মী হাছান আলীর কাছে। তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। জানতে চাইলে বললেন, স্যার ভিসি হওয়ার আগে ব্রিটিশ কাউন্সিল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় ১১নং ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন। তখন তিনি সেখানে বিড়াল পুষতেন। ভিসি হওয়ার পরে তার দুই ভাতিজিকে নিয়ে একা থাকতেন উপচার্যের বাসভবনে।
এই কষ্ট এবং ব্যর্থতা মনিরুজ্জামানকে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার রসদও জুগিয়েছে। কর্মক্ষেত্রে ছিলেন আপন মহিমায় উজ্জ্বল। শিক্ষকতা দিয়েই কর্মজীবন শুরু। ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ইউনির্ভাসিটি অব প্যারিস যান। সেখান থেকে ফিরে ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৮৬ সালে অধ্যাপকে পদোন্নতি পান।
১৯৯০ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ দায়িত্ব ১৯৯২ সালের ১লা নভেম্বর পর্যন্ত পালন করেন। এ বছরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। পরে সেনেগালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ১৯৩৫ সালের ১লা মে ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫১ সালে কৃষ্ণ গোবিন্দ হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৩ সালে আইএসসি পাস করেন।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ ও গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১৫টি। গবেষণাপত্রগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নাল ও সংকলনগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।