এক মিনিট থমকে দাঁড়ালো ‘বইমেলা’
ঢাকা : ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ৪টা। অমর একুশে গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দী অংশে তখন মানুষের ঢল। প্রবেশপথগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। ঠিক তখনই বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের মাইকে ঘোষণা এলো, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের আহ্বান। এক মিনিটের জন্য যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়েই স্মরণ করেন প্রয়াত ওই বিজ্ঞানলেখককে। এরপর নীরবতা ভেঙে দলে দলে দর্শনার্থীরা প্রবেশ করে মেলার দুই প্রাঙ্গণে। তারপর বই কেনার ধুম। এক মিনিট পরই যেন জমজমাট হয়ে ওঠে বইমেলা!
গতবছর বইমেলার ২৬তম দিনে মেলা থেকে ফেরার পথে উগ্রবাদীদের চাপাতির কোপে নির্মমভাবে নিহত হন লেখক অভিজিৎ রায়। এ সময় সঙ্গে থাকা তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর জখম হন। চাপাতির কোপে তিনি হারান একটি আঙুল। এ ছাড়া ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে কোনোরকমে প্রাণে বাঁচেন তিনি।
গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অভিজিৎ রায়কে স্মরণ করে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘মৌলবাদী- সাম্প্রদায়িক চক্র মুক্তবুদ্ধির লেখকদের হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অন্ধকারের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।’ তিনি অভিজিৎ হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেন।
প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বর অভিজিৎ রায়ের চারটি বই প্রকাশ করেছিল। দুটি একক ও দুটি যৌথ লেখা। বই চারটি হলো ‘সমকামিতা’ ও ‘ভালোবাসা কারে কয়’ এবং ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’। স্টলের সামনেই সাজানো ছিল বইগুলো। কিছু বইতে দেখা গেল বৃষ্টিতে ভেজার দাগ। অভিজিৎ স্মরণে এ স্টলের দেয়ালে সেঁটে দেয়া হয়েছে দুইটি ছোট্ট ব্যানার। একটি লেখা ‘জাস্টিস ফর অভিজিৎ’ অপরটিতে ‘ওয়ার্ডস ডোন্ট কিল, পিপল ডু’।
শুদ্ধস্বরে আসামাত্র এক দর্শনার্থী চাইলেন অভিজৎ রায়ের বই। বিক্রয়কর্মী দেখিয়ে দিলেন সাজানো অংশটি। রাজীব বিশ্বাস নামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এ দর্শনার্থী অভিজিৎ হত্যার নিন্দা জানালেন। বললেন, ‘যারা মেরেছেন তারা অভিজিৎ রায়ের বই পড়েইনি। শুধুই অন্ধতার বশে এ হত্যা মেনে নেয়া যায় না।’
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ হত্যাকণ্ডের বিচার করার দাবি জানিয়ে রাজীব বলেন, ‘উনি যা বলেছেন তা যৌক্তিকভাবে বলেছেন। একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি বলতে পারি, তার লেখায় যুক্তি ছিল, তথ্যবহুল ছিল লেখা। একটি অনগ্রসর জাতি বলে এ হত্যা মেনে নিয়েছে জাতি। এটা দুঃখজনক।’
তবে দুটি ব্যানার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি শুদ্ধস্বরের স্টলে। এর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলও উগ্রবাদীদের আঘাতে জর্জরিত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান। এখন তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। শুদ্ধস্বরের বিক্রয়কর্মী সবুজ বলেন, ‘টুটুল ভাই দেশের বাইরে। তিনিই এ ব্যানার লাগাতে বলেছিলেন। এ ছাড়া তার স্মরণে বিশেষ কিছু করা হয়নি।’
জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন অভিজিৎ হত্যার দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়ে বাংলামেইলকে বলেছেন, ‘অভিজিতের কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। এখনও বিচার হলো না, এখনও এ মামলাটির অগ্রগতি হলো না, এ খুবই দুঃখজনক। যত দ্রুত সম্ভব এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব লেখকের উচিত এমনভাবে লেখা, যাতে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আঘাত দেয়া না হয়ে যায়। আমি এর বিপক্ষে।’
বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে বাংলা একাডেমির অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রকাশকদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই উগ্রবাদীদের হাতে খুন হওয়া বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়, জাগৃতি প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফীন দীপন ও গুরুতর জখম শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলকে স্মরণ করেন প্রকাশকেরা। এ সময় তারা এসব ঘটনার দ্রুত বিচার ও প্রকাশকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।
এ ছাড়া মেলার আয়োজন ও পরিচালনার ভার প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান প্রকাশকেরা। তাদের দাবি, বাকি ৩ দিন যেন মেলার সময় বাড়িয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত করা হয়। শিলাঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষায় ক্ষতিপূরণেরও জোর দাবি জানান তারা।
শুক্রবার ছিল শিশুপ্রহর। এবারের গ্রন্থমেলায় এটি ছিল সর্বশেষ শিশুপ্রহর। সকালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সংগীত, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে মূল মঞ্চে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
ভাষাপ্রকাশ-কাব্যমালাঞ্জলি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা
চতুর্থবারের মতো বইমেলায় ঘোষণা করা হয়েছে ভাষাপ্রকাশ-কাব্যমালাঞ্জলি সাহিত্য পুরস্কার। এবার কথাসাহিত্যে এ পুরস্কার পেয়েছেন সাদাত উল্লাহ খান। কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন বদরুল হায়দার। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে পুরস্কার পেয়েছেন, কবিতায় ফোরকান উদ্দিন আহমেদ, লিটল ম্যাগাজিনে কাশবন সম্পাদক মিন্টু হক, কবিতাপত্রের শব্দবিন্যাসে রানা জামান, আবৃত্তিতে ফাতেমা আমিন, প্রচ্ছদে রেজাউন নবী ও নজীব তারেক এবং স্মৃতিকথায় শেখ সাহেদ।
মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘২০২১ সালের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং রাশিদ আশকারী। সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ. কে. আজাদ চৌধুরী।
প্রাবন্ধিক বলেন, ‘জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারে ইংরেজি ভাষার সকল প্রয়োজনীয় মূল জ্ঞানের আধার বইসমূহকে প্রথমেই বাংলায় অনুবাদ করে নিতে হবে। নইলে দর্শন, ইতিহাস, গণিত, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা সম্পর্কে যে জ্ঞানভাণ্ডার ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার বইতে সংরক্ষিত রয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত রেখে উচ্চশিক্ষার্থীগণকে সত্যিকারভাবে জ্ঞানী করে তোলা যাবে না।’
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন লাবণ্য আহমেদের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘গীতিমালিকা’-এর শিল্পীরা। এছাড়াও সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর, আবদুল জাব্বার, তিমির নন্দী, মনোরঞ্জন গোষাল, নমিতা ঘোষ, শিবু রায়, বিশ্বজিৎ রায়, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, শফিউল আলম রাজা, পল্লবী সরকার মালতী ও আরিফ রহমান।
নতুন বই
বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, শুক্রবার বইমেলায় নতুন বই এসেছে ১৯৬টি। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে পুথিনিলয় এনেছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘যত ভালবাসা পাই’ ও ‘মেঘবালিকা’, জয়তী এনেছে ওমর ফারুক চৌধুরীর ‘শান্তির বিশ্ব নেতা রাষ্ট্র নায়ক শেখ হাসিনা’, ‘রাষ্ট্র নায়ক শেখ হাসিনার দর্শন’, বেহুলাবাংলা এনেছে মোহিত উল আলমের ‘গ্রেনেড’, অনুপম প্রকাশনী এনেছে হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক উপন্যাস’, ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা’, বলাকা প্রকাশনী এনেছে শরীফা বুলবুলের ‘বীরাঙ্গনা নয় মুক্তিযোদ্ধা’, চন্দ্রছাপ এনেছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘দশ রঙের ছড়া’, চর্চা গ্রন্থপ্রকাশ এনেছে যতীন সরকারের ‘বাংলার লোক সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ’, জাতীয় গ্রন্থপ্রকাশ এনেছে এ কে এম শহীদুল হকের ‘ আমার পাঁচমিশালী গান’।
শনিবারের আয়োজন
শনিবার গ্রন্থমেলা শুরু হবে সকাল সাড়ে ১০টায় এবং শেষ হবে যথারীতি রাত ৮টায়। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘৬ দফার পঞ্চাশ বছর’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ড. আবুল বারকাত, সুভাষ সিংহ রায় ও অজয় দাশগুপ্ত। সভাপতিত্ব করবেন ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। এ ছাড়া প্রতিদিনকার মতো সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।