চুনোপুঁটিদের গ্রেপ্তারের ধুম, নিরাপদে রাঘববোয়ালরা
ঢাকা : নতুন চেয়ারম্যান যোগদানের পর হঠাৎ করেই গ্রেপ্তার অভিযানে সক্রিয় হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই কমিশনের ৫৩ দিনেই বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি মামলার ১১৮ আসামিকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি বিরোধি সংস্থাটি। যেমনটি আগের কমিশনের আমলে লক্ষ্য করা যায়নি।
এসব গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে সর্বনিম্ন ২৬ হাজার টাকা আত্মসাতে মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলেও, এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন আলোচিত ও হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ মামলার প্রভাবশালী আসামিরা। যারা এখনো জামিন না নিয়েই আছেন বহাল তবিয়তে। তাদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তি, ধনকুবের, নাট্যব্যাক্তিত্ব এবং আলোচিত বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির আসামিরা।
দুদকের এই গ্রেপ্তার কার্যক্রমকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও একই মাপকাঠিতে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করেন, ব্যক্তি পরিচয় ব্যতিরেকে ছোট-বড় সব অভিযুক্তকে ধরতে না পারলে দুদকের এই গ্রেপ্তার কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
২০০৭ সালে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল দুদক। এরপর গত ৯ বছরে তেমন কোনো গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করেনি সংস্থাটি। গত ১৪ মার্চ দুদক চেয়ারম্যানের হিসেবে সাবেক সচিব ইকবাল মাহমুদের যোগদানের পর থেকেই সারাদেশব্যাপি শুরু হয় দুর্নীতি মামলার আসামিদের টানা গ্রেপ্তার অভিযান। নতুন এই কমিশনের ৫৩ দিনে ১১৮ আসামিকে গ্রেপ্তার করে দুদক কর্মকর্তারা। তবে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে হাজার হাজার দুর্নীতি মামলার আসামিরা।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৩৬৪টি। যার মধ্যে ৬১৯টি মামলা হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে মার্চ মাস সময়ে। সম্প্রতি করা এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি আছেন প্রায় ১ হাজারেরও বেশি। এছাড়া ব্যুরো ও কমিশনের আমল মিলে এখনো বিচারাধীন মামলা আছে ২৩ হাজার ২৪৬টি। বিচারধীন মামলায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ব্যাংকারসহ প্রভাবশালী আসামি আছে কয়েক হাজার।
দুদক সূত্রে আরো জানা যায়, এসব ছাড়াও সম্প্রতি মামলা করা অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জামিন না নেয়া সত্ত্বেও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। এর মধ্যে আছেন স্বঘোষিত ধনকুবের প্রিন্স মুসা খ্যাত মুসা বিন শমসের। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য প্রদানের অভিযোগে গত ১০ মার্চ রাজধানীর রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া গ্রেপ্তার করা হয়নি জাতীয় পার্টির নেতা ও ঢাকা-৬ আসনের সাংসদ কাজী ফিরোজ রশিদকেও। তিনি জাল দলিল সৃষ্টি করে অবৈধভাবে জমি দখল করা মামলার আসামি।
আলোচিত ব্যাক্তির মধ্যে আছেন জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেতা পীযুষ বন্দোপাধ্যায়। তার বিরুদ্ধে এফডিসির ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার ৫২০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা একটি মামলা আছে।
অপরদিকে বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় করা ৫৬ মামলায় আসামির ছিল ১২০ জন। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫ ব্যাংকার ও ৩ ব্যবসায়ী। অন্যরা এখনো বাইরে। বাইরে থাকার মধ্যে আছেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ মোনায়েম খান ও কনক কুমার পুরকায়স্থ এবং সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মঞ্জুর মোর্শেদসহ প্রধান আসামিরা। অর্থ আত্মসাতের ওই ৫৬ মামলার ৭৯ জন ব্যবসায়ীও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এছাড়া বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি জালিয়াতির ঘটনায় করা ১২ মামলার কোনো আসামিকেই গ্রেপ্তার হয়নি। এখনো গ্রেপ্তার হয়নি- অবৈধ সম্পদ অর্জন মামলায় মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি আহসান উজ-জামান, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি মামলায় ইউসিবিএল ব্যাংকের সাবেক ৯ কর্মকর্তা, জনতা ব্যাংক থেকে ২৫১ কোটি টাকা আত্মসাৎ মামলায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি মনজেরুল ইসলামসহ বাকি আসামিরা, সোনালী ব্যাংকের এনসিটিবি শাখার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী এনামুল হক, মফিজুল ইসলাম ও নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল হোসেন।
দুদকের এই গ্রেপ্তার তৎপরাতে কিভাবে দেখছেন?- জানতে চাওয়া হয়েছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের কাছে। তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘দুদক সক্রিয়ভাবে কাজ করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা। ফলে যারা দুর্নীতি করেন তারা যেন বিচারের সম্মুখীন হয়। তবে এটা আশা করবো যে তাদের গ্রেপ্তার কার্যক্রম যেন সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ট হয় এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় করা হয়।’
তিনি বলেন, আইনগতভাবে গ্রেপ্তার করার বিষয়ে দুদকের যে দায়িত্ব আছে, সেটা সক্রিয়ভাবে পালন করবে। কারো পরিচয় বা ব্যাক্তির উপর নির্ভর করে অভিযান পরিচালনা করবে এটা আমরা আশা করি না। সবাইকে একই মাপকাঠিতে দেখতে হবে। কেননা আইনের চখে সবাই সমান।
এ ব্যাপারে দুদকের সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল বাংলামেইলকে বলেন, প্রতিটি মামলার ধরন ও প্রকৃতি একেক রকম। মামলার তদন্ত কাজ কিভাবে পরিচালনা করতে হবে তার দায়িত্ব থাকে তদন্ত কর্মকর্তার উপর। তদন্ত কর্মকর্তা শুধুমাত্র চাইলেই তদন্তস্বার্থে তার কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এব্যাপারে কমিশন কোন নির্দেশ দেয় না, তদন্তের স্বার্থে তারা গ্রেপ্তার করছে।
তাহলে প্রভাবশালী আসামিদের কেন ধরা হচ্ছে না- এব্যাপারে জানতে চাইলে সচিব বলেন, আমাদের কাছে সকল আসামিই সমান। কোন আসামিই প্রভাবশালী নয়। তদন্ত কর্মকর্তা যাকে গ্রেফতারের প্রয়োজন বলে মনে করবেন তাকেই গ্রেপ্তার করবেন। আমি এ ব্যাপারে বেশি কিছু বলতে পারবো না।