ট্যানারি মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতাই বুড়িগঙ্গার মরণবিষ
ঢাকা : একসময় বুড়িগঙ্গা নদী ছিল ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র। সেজন্য বুড়িগঙ্গা নদীর তীরেই ঢাকার পুরোনো শহর গড়ে উঠেছিল। কিন্তু যে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শহর, সেই বুড়িগঙ্গার এখন মরণ দশা। বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে ১৮০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক আবাসিক প্রতিনিধি জন টেইলর লিখেছিলেন- বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।
তবে বুড়িগঙ্গার সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। প্রতিনিয়ত হাজারীবাগের ট্যানারি আর পুরান ঢাকার শত শত প্লাষ্টিক ও রঙ কারখানার তরল বর্জ্য এসে পড়ছে নদীতে। একটু একটু করে ফেলা আবর্জনা যতই বাড়ছে, ততই কমছে নদীর আকার। এসব নিয়ে কারো যেন কোন মাথা ব্যথাই নেই। উল্টো দিন যত যাচ্ছে সমস্যা আরো প্রকট হচ্ছে।
সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হল হাজারীবাগের ট্যানারি থেকে প্রতিদিন ২২ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য নিঃসরিত হয়। যার ফলে বুড়িগঙ্গার পানির সাথে মিশে যাচ্ছে ক্রোমিয়াম নামের ভয়ঙ্কর এক রাসায়নিক। যা মানবদেহে ক্যান্সার ছড়ায়। সার্বিকভাবে ট্যানারির বর্জ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে লাখ লাখ মানুষের।
নানা সমালোচনা ও আন্দোলনের পরেও হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানো সম্ভব হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে চামড়া শিল্প দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জকারী খাত। আর সে কারণেই হাইকোর্টের রায়ের পরও এখন পর্যন্ত ট্যানারি স্থানান্তরে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
ট্যানারির বর্জ্যে বুড়িগঙ্গা দূষণের বিষয়টি জানা সত্ত্বেও হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরে স্বেচ্ছাচারি মনোভাব দেখাচ্ছেন মালিকরা। সরকারি সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কারখানা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ট্যানারি স্থানান্তর বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলামেইলকে বলেন, ‘সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের কাজ চলছে। সবমিলিয়ে আরও চার বা পাঁচ মাস সময় লাগবে। এসময়ের মধ্যেই ট্যানারিগুলো স্থানান্তর করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’
তবে ট্যানারি মালিকরা বিষয়টিকে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন বলে মনে করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশবিদ প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। তার মতে, বুড়িগঙ্গা দূষণের ফলে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছেন না মালিকরা। তারা শুধু মুনাফার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। কিন্তু বিষয়টিকে পরিবেশ ও জনস্বাস্থের দিক থেকে অনুধাবন করা উচিত।
নির্দিষ্ট সময়সমীমা শেষ হওয়ার পরেও হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি না সরায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মূলত এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিদ্যমান আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। ইটিপি না থাকায় ইতিপূর্বে সরকার বিভিন্ন কারখানাকে জরিমানা করলেও হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোর ক্ষেত্রে সে ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’
এদিকে একটি অসাধু চক্র প্লাষ্টিক, ইট, কাঠসহ কঠিন বর্জ্য ফেলে নষ্ট করছে বুড়িগঙ্গার পানি প্রবাহ। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে সেই দিন হয়ত দূরে নয় যখন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল।
এ বিষয়ে পানি বিশেষজ্ঞ ড. এন আই খান বলেন, ‘পৃথিবীর প্রতিটি দেশে শিল্প কারখানা আছে। মূলত শিল্পের বর্জ্য শোধন করে নদীতে ফেলতে হয়। কিন্তু বুড়িগঙ্গায় ট্যানারির যেসব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তা নদীর জন্য খুবই বিরুপ প্রভাব ফেলছে। নদীতে এখন আর পানি নেই, সব যেন আলকাতড়ায় রুপান্তরিত হয়েছে।’
তবে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরালে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ কমলেও সাভারের নদীগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে মনে করেন তিনি।
বিসিক সূত্রে জানা যায়, হাজারীবাগের সব ট্যানারি সাভারে সরাতে ২০০৩ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়; যার ব্যয় ধরা হয় ১০৭৮.৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুদান বাবদ ধরা হয় ২৫০ কোটি টাকা। আর সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড, এসটিপি, এসপিজিএস ও এসডব্লিউএমএস নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৬৩৮.৭৯ কোটি টাকা। অন্যান্য উন্নয়ন ও রাজস্ব ব্যয় ধরা হয় ১৮৯.৯২ কোটি টাকা।
চামড়া শিল্প এলাকা প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা ১৯৯ দশমিক ৪০ একর জমির মধ্যে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) হবে ১৭ একরের ওপর। সেখানে ২০৫টি প্লটের মধ্যে শিল্প ইউনিট হবে ১৫৫টি।
বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ করেছিলেন বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁ। তার শাষণামলে শহরের যেসকল অংশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রতি রাতে আলোক সজ্জা করা হতো। এছাড়া নদীর বুকে অংসখ্য নৌকাতে জ্বলতো ফানুস বাতি। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরুপ সৌন্দের্য্যের সৃষ্টি হতো। সেসব ঘটনা এখন শুধুই অতীত। দখল আর দূষণে বুড়িগঙ্গা এখন তার জৌলুস হারিয়েছে।
ঢাকা মহানগরীর জনস্বাস্থ্যে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ একটি মারাত্বক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাতভর মাল টানার কাজ করেছেন মজনু মিয়া। তাই খুব সকাল সকালই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। শহরে একা থাকেন বলে নেই কোন আলাদা বাসস্থান, তাইতো সদরঘাট টার্মিনালের পাশেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকেন। কিন্তু তার সেই ঘুম কি আসলেই স্বস্তির, নাকি অস্বস্তির তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ, আলাদা বাসা নিয়ে থাকলে পরিবার চালামু ক্যামনে। হের লইগ্গাই এইহানে ঘুমাই। কি আর কমু এতো গন্ধ, দম লওন যায় না। যে যেমনে ইচ্ছা ময়লা ফালায়, এইর লইগ্গাইতো পানি কালা ওইয়া গেছে। কারখানাগুলোর পচা পানির লগ্গাই এমন অইছে। মনে হয় না বেশিদিন এই টার্মিনালের পাশে ঘুমান যাইবো।’
বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণমাত্রা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের জন্য ২০১৩ সালের জুন মাস থেকে নিয়মিতভাবে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন স্থানের ডিও এবংপিএইচ এর পরিমাণ পরীক্ষা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় পবা’র একটি বিশেষজ্ঞ দল সর্বশেষ চলতি বছরের ৩ মার্চ চারটি নদীর দূষণ পরীক্ষা এবং দখল-ভরাট পর্যবেক্ষণ করে। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলে হচ্ছে- সদরঘাট এলাকায় ডিও এর পরিমাণ প্রতি লিটারে ০ দশমিক ১৫ মিলিগ্রাম, ধোলাইখালে ০ দশমিক ২৫ মিলিগ্রাম, পাগলা বাজারে ০ দশমিক ৩০ মিলিগ্রাম, চাদনী ঘাটে ০ দশমিক ১৪ মিলিগ্রাম, শিকদার মেডিকেলে ০ দশমিক ৩০ মিলিগ্রাম, গাবতলী বিআইডব্লিউটিএ টার্মিনাল ৯ দশমিক ২৩ মিলিগ্রাম। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে সদরঘাটে ডিও এর পরিমাণ সবচেয়ে কম।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী খাবার পানির উৎস হিসাবে নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতি লিটারে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৬ মিলিগ্রামের ঊর্ধ্বে এবং মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জন্য প্রতি লিটারে দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫ মিলিগ্রামের ঊর্ধ্বে থাকা প্রয়োজন।
পবা’র ফলাফল পর্যলোচনায় দেখা যায় যে, শুষ্ক মৌসুমে বুড়িগঙ্গা এলাকায় দ্রবিভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে প্রায় শুণ্য মিলিগ্রাম। যা অত্যন্ত ভয়াবহ। অর্থাৎ এসব নদীর পানি মৎস্য চাষ, সেচকাজ, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কাজে ব্যবহার অনপুযোগী। এছাড়াও পরিদর্শনকালে নদীর দুপাশে বিপুল পরিমাণ গৃহস্থালি ও কঠিন বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। বর্ষাকালে নদীর পানি বাড়ার সাথে সাথে এসব বর্জ্য নদীর পানিতে ছড়িয়ে পড়ে, যা দূষণমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
এদিকে ট্যানারি হতে নির্গত বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য শুধু বুড়িগঙ্গার পানিকেই দূষিত করছে না, নদীর তলদেশ ও উভয় পাড়ের মাটি এমনকি বাতাসকেও ভয়াবহভাবে দূষিত করছে। ট্যানারিগুলো সাভার ও কেরানীগঞ্জে চামড়া শিল্প নগরীতে সরানোর সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় নদীর দূষণ মাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে। যদিও দখল দূষণ রোধের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু কার্যত এ ক্ষেত্রে খুব একটা তৎপরতা দেখা যায় না।
সবকিছু ছাপিয়ে স্বস্তির খবর হলো মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গার প্রাণ ফিরিরে আনতে বিশ্বব্যাংক ও ডিএসসিসির যৌথ অর্থায়নে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মূল অবস্থান ঠিক রেখে সিঙ্গাপুরের কালং ও সিঙ্গাপুর নদী এবং বাংলাদেশের হাতিরঝিলের আদলেই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ফিরে আনা হবে। নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হবে পুরো নদীজুড়ে।