যে বিদ্যালয়ে পড়তে কোনো টাকা লাগে না
কুষ্টিয়া : শিক্ষা মানে আলো। কিন্তু এই আলো পেতেও আমাদের গুনতে হয় কাড়ি কাড়ি টাকা। আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কথা না-ই বা বললাম। তবু যেখানেই আপনার সন্তানকে সেই আলোই আলোকিত করতে চান তা বিনামূলে কি সম্ভব? সমস্বরে সবাই না শব্দটিই বলবো। কিন্তু কোথাও কোথাও প্রকৃতির মতোই বিনামূলে আলো অর্থাৎ শিক্ষাদান করা হয়।
কুষ্টিয়া শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলায় অবস্থিত লক্ষ্মীপুর হাসানবাগ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। সাড়ে ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে অধ্যায়ন করছে। ব্যতিক্রমী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। লেখাপড়া করতে শিক্ষার্থীদের কোনো অর্থেরই প্রয়োজন পড়ে না। তবে সেটি বর্তমান এডহক ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এইচএম আবুল কালাম আজাদের (এফসিএ) মহানুভবতায়।
এই বিদ্যালয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনেও রয়েছে ব্যতিক্রম চিত্র। শুভ নববর্ষের দিনে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ডেকে, মা সমাবেশে মায়েদের মধ্যে শাড়ি দেয়াসহ কয়েক হাজার মানুষকে লুচি ও আলুর দম খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ৮ জন শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে মানুষ করতে, উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যাবতীয় খরচ বহন করে থাকেন এইচএম আবুল কালাম আজাদ।
শুধু তাদের পড়ালেখার খরচ নয়, সেসব শিক্ষার্থীদের পোশাক দিয়ে তাদের সন্তুষ্টি করার পাশপাশি প্রাইভেট ও কোচিংয়ের মাধ্যমে তাদের লেখাপড়ার মান বৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে।
সেই স্বপ্নদ্রষ্টা এইচএম আবুল কালাম আজাদ জানালেন তার অনুভূতি। তিনি বলেন, ‘আমার দুইটা মেয়ে। আর সেই দুইটি মেয়ে চিকিৎসক। তারা মানবসেবাই নিয়োজিত রয়েছে। আমি চাই আমার এলাকার শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ হয়ে উঠুক। সেইসঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।’
ষষ্ঠ থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো সেকশনেই ভর্তি ফি, সেশন চার্জ, খেলাধুলার ফি লাগে না। খাতা ও কলম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। এতে করে এই বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান নিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এই বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে কোনো অর্থই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হয় না। শুধু তাই নয়, এসএসসির ফরম পূরণের যে অর্থ সেটিও বহন করে এইচ এম আবুল কালাম আজাদ।
এছাড়া, এই বিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষককে প্রতি মাসে সাড়ে ২৫ হাজার টাকা সম্মানিভাতা হিসেবে বণ্টন করা হয়। ১০১ শতক জমির ওপর গড়ে ওঠা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বর্তমানে শিক্ষার হার ৯৫%। কারিগরি ও বিজ্ঞান ভবনের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে ২ কোটি ৭০ লাখ ব্যায়ে নতুন ভবন নির্মানের কাজ চলছে।
সম্প্রতি বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য সায়েন্স ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিজ্ঞানাগারের নামকরণ করা হয় ‘রোকেয়া মান্নান বিজ্ঞানাগার’।
নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফাতেমা খাতুন বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমি এ স্কুলে পড়ালেখা করছি। এখানে লেখাপড়া করতে কোনো টাকার প্রয়োজন হয় না। শুধু তাই নয়, আমিসহ আমার সহপাঠীদের নিয়মিত পড়ালেখার খোঁজখবর নিয়ে থাকেন তারা। এই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার ফলে অন্য কোথাও প্রাইভেট পড়ার দরকার পড়ে না।’
তার মতো ৬ষ্ঠ শ্রেণির ইলমা খাতুন ও ৮ম শ্রেণির তৃষ্ণা খাতুনও একই সুরে জানান তাদের প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতে কোনো টাকার প্রয়াজন হয় না। ভর্তি ফি বা সেশন চার্জও নেই। নেই খেলাধুলারও ফি। এরকম বিদ্যালয় আর অন্য কোথাও আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই বলেও জানান স্কুল কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামসুল আলম বাংলামেইলকে বলেন, ‘এলাকার এই মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার হার ৯৫%। নন এমপিওভুক্ত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমাদের শিক্ষকদের জন্য প্রতিমাসে সাড়ে ২৫ হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে দেয়া হয়। এছাড়াও বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর, অবকাঠামোসহ চেয়ার-বেঞ্চ ও ১০টি কম্পিউটার, কম্পিউটার ল্যাবে সিসি ক্যামেরা ও শিক্ষা সরঞ্জামাদীসহ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আরও জানান, সভাপতি এইচএম আবুল কালাম আজাদ স্যারের উদ্যোগে এই বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ‘রোকেয়া মান্নান’ শিক্ষাবৃত্তি পেতে থাকবে।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মতিউর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশকে উন্নত করতে হলে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এ বিদ্যালয়ে কারিগরি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য একাডেমিক ভবনের কাজ চলছে।’
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ফজলুর হক বাংলামেইলকে বলেন, ‘বিনামূল্যে যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়া হয় এরকম নজির আমার জানা নেই। এ বিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে কোনো প্রকার টাকার দরকার হয় না শিক্ষার্থীদের। আমি নিজেও এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের ফলাফলও আমরা সন্তুষ্ট।’