তুমি তো বই, তোমাকে পড়ব

অামার পঁচিশ বছর বয়সে যে বইটা পড়তে গিয়ে খুব দুর্বোধ্য লেগেছিল, বই-পত্রিকা তখনো লেটার প্রেসেই ছাপা হতো, চিঠি লেখা হতো হাতে, ভালোবাসা লেখা অশ্রু অার রক্তে, সেটা কোনকালের কথা? নিশ্চয়ই নেতাজি সুবাস বোসের অামলের কথা বলছি না, বলছি এই সেদিনের কথা। একটা বই অামি ঠিকমতো পড়েই উঠতে পালাম না, যেটুকু বা পড়েছি, বুঝতে পারিনি। সেটা কবেকার কথা? এই তো সেদিন, এই মোবাইল ফোন অাসার অাগে-অাগেই, তখনো বইমেলা জমজমাট হতো। পহেলা বসন্তে হলুদ-বাসন্তী শাড়ি পরে মেয়েরা বকুলতলায় সেজেগুজে অাসত, বইমেলায় ঘুরত। তো সেই সময়, অামি যে বইটা পড়ে বুঝতে পারিনি বা যে বইটা পড়তে গিয়ে অামার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, সেই বইয়ের নাম, সেগুফতা শারমিন। খুব পরিপাটি সুন্দর, ঝকঝকে অভিব্যক্তি কিন্তু বেশিরভাগ রাতেই সে ঘুমোত না, সেই না-ঘুমোনোর ছাপ তার চোখে লেগে থাকতে, মুখে লেগে থাকত। অামি সেগুফতা শারমিনকে পড়তে চাইতাম, কিন্তু সে বড় দুর্বোধ্য, সে বড় জটিল, সে বড় কঠিন হিয়া, এই কারণে প্রত্যেকবছর বইমেলায় অামি তারে বেড়াই খুঁজিয়া। হিয়ার সঙ্গে অন্তমিল দিতেই কি এখানে সাধুশব্দ, ‘খুঁজিয়া’?

তো এই যে বইমেলা অাসে, বইমেলা যায়, বসন্ত অাসে বসন্ত যায়, কোকিলেরা গায়, ফুলেরাও ফোটে, মনও তাই ছোটে, কোথায়? কবিতায়, গল্প-উপন্যাসের প‌্যারায়, ঘটনার বা চরিত্রের ওঠানামায়? এই যে শাহবাগ-টিএসসি-বাংলা একাডেমি-সোহরাওয়ার্দি উদ্যান টানটান হয়ে থাকে, কেন থাকে? কার জন্যে থাকে? অামি নিশ্চিত, সুমনা হকের জন্যে থাকে। সুমনা হক একটি কাব্যগ্রন্থের নাম। বইমেলায় কখনো সেই বইটি খুঁজে পাইনি, পরে, শাহবাগের অাজিজ মার্কেটের বইপাড়া, কাঁটাবনের কনকর্ডের বইয়ের দোকানের কোনো তাকেই অামি তাকে দেখতে পা্ইনি। তাই পড়তেও পারিনি, তাকে। কাকে? সুমনা হককে। কারণ, সুমনা হক সেই কবিতার বই, যার দীর্ঘ চুল অামাকে বনলতা সেনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সুমনা হকের চোখের মধ্যেই তো মুদ্রিত, সাতটি তারার তিমির!

সেগুফতা শারমিনকে তো পড়তেই পারিনি কিন্তু দূর থেকে তাকে তাকিয়ে দেখেই পড়েছি,  বুঝেছি বই কী জন্যে এত গুরুত্বপূর্ণ! কারণ, সিমিও ছিল একটি বই, শ্যামামেয়ে, মিষ্টি একটা মুখ, কপালে লাল টিপ পরত। মেরাদিয়ার দিকে ওরা থাকত, সিমি পড়ালেখা করত নারায়ণগঞ্জ চারুকলায়, খুব ভালো ছবি অাঁকত সিমি, সিমিকে অামরা অনেকেই চিনি, সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠার  জন্যে খুব লড়াকু একটি মেয়ে,  শাহবাগ-চারুকলা অঞ্চলে বন্ধুদের সঙ্গে অাড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ওর একটু দেরি হয়ে যেত। সন্ধ্যা বা এই একটু রাতের অন্ধকারে মেরাদিয়ায় সিমিদের বাড়ির কাছের পাড়ার ছেলেরা সিমিকে রাস্তায় নাজেহাল করত।  খুব সুন্দর মেয়েটি, সিমি, একদিন বাড়িতে ফিরে বাবা-মা’র কাছেও নিজেকে অসহ্য মনে করে অাত্মহত্যা করল। মনে হয় যে, সিমি যদি একটি বই হ্য়, তাকে এই সোসাইটি পড়তে পারেনি। অামরাই পারিনি। কারণ, সিমিকে যখন অাত্মহত্যা করে চলে যেতে হয়, তখন অামরা বেঁচে থাকারা অযোগ্য হয়ে পড়ি। অামাদের অার্ট-কালচার এখনো ব্যক্তির রুটি-রুজি উৎপাদনে ব্যস্ত, এটাই ফুটে ওঠে। সেজন্যে এই অার্ট, এই কালচার, এই বাংলাবাজারি গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধের বই দিয়ে বিশেষ কিছু হয় না, হচ্ছেও না। বইমলায় কী পরিমাণে যে জীবনীগ্রন্থ বের হয়, কিন্তু সমাজ যে বর্বর এখনো, তা প্রমাণ করে জীবন দিয়ে গেল যে মেয়েটি,  তার কোনো জীবনী লেখা হবে না। কেন? ধরা যাক, অাগামী বইমেলায় প্রকাশযোগ্যতার ভিত্তিতে অামি একটি পাণ্ডুলিপি জমা দিতে চাই বাংলা একাডেমির জীবনীগ্রন্থমালার সিরিজে, নাম, সিমির জীবনী, ছাপা হবে? সিমি তো একজন শিক্ষনবিশ অার্টিস্ট, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ছবিও এঁকে যেতে পারেনি, কিন্তু যারা অনেক লিখেছেন, খ্যাতিও পেয়েছেন লেখক হিসেবে, অনেক অর্থ-পুরষ্কার পেয়েছেন, তা তার অর্জন বটে, কিন্তু সেই খ্যাতিমান লেখক বা শিল্পীর সমাজে অনেক অনেক সিমিকে যখন অাত্মহত্যা করে চলে যেতে হয়, মরে যেতে হয় নিজের জীবনের ওপর ঘৃণা নিয়ে, বুঝতে পারি, খ্যাতিমান কবি বা শিল্পীর গৌরবজনক স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, মৃত্যুর পরও তারা অারো মহান হয়ে থাকেন, তাদের স্মরণ করা হয়; কিন্তু খুবই অস্বাভাবিকভাবে সিমিদের শুধু নিজের মতো করে বেঁচে থাকতেই দেয়নি যে সমাজ, সেই সমাজে বসেই তো কবি-লেখক-শিল্পী খ্যাতি-অর্থ-অমরত্ব কুড়োচ্ছেন। তাই একটা দুইটা বা একশো দুইশো অসার গ্রন্থের লেখকেরও অনেক পরিচিতি হয়, তিনিও পুরষ্কৃত হন, তারপর একদিন বয়সের ভারে তার মৃত্যু হলে তখন তারও অাত্বজীবনী লেখা হয়, কিন্তু সিমির জীবনী লেখা হয় না, হবেও না, কারণ, সিমিকে অাত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করেছে পুরো এই সোসাইটি, অামরাই, তাই সিমির জীবনী লেখা হলে অামরাই অভিযুক্ত হয়ে পড়ি। মানুষ অভিযোগ নিতে পারে না। ‘যে জীবন সিমির’ তা পড়তে চায় না, কিন্তু বইমেলা থেকে টাকা দিয়ে লেখকের অটোগ্রাফসহ সেলফি তুলে কিনে নিয়ে যায়, ‘কুমির মামার বিয়ের বরযাত্রী’। অামরা মানুষ তয়তো এই জাতের প্রাণী।

সিমির জীবনী তাই এই সমাজ পাঠ করতে চায় না। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় কতজন সিমি অাছে? কতজন সিমি মরে গিয়েছে, অাত্মহত্যা করেছে কতজন, হত্যা করা হয়েছে কতজনকে? প্রতিদিন কারা সিমিদের হত্যা করে? এই যে, অামরা যারা ভালো মানুষের ভাব ধরে সততা শো করে বেঁচে থাকতে ভালোবাসি। অামরা যারা বইমেলায় যাই, গানবাজনা করি, থেটার করি, সিনেমা বা পুঁজির দাসত্বে অার্ট-কালচার করি, কোনো না কোনোভাবে অামরাই সিমিদের হত্যার জন্যে দায়ী। তাই, গ্রন্থই কেবল গ্রন্থ নয়, মানুষই প্রধান গ্রন্থ, যদি ভাবি, তাহলে সিমিও একটি কবিতার বই, যে বইটার মূল পাণ্ডুলিপিসহ সব কপি পুড়ে গেছে। পুড়িয়ে দিয়েছে সমাজ, যারা অাবার বইমেলা ভালোবাসে, পহেলা বৈশাখেও রোদে পুড়ে রাস্তায় ঘোরে।

হঠাৎ একটা কোকিল দিল যাক, সিমির কথা অাপাতত থাক। রিমির কথা মনে পড়ল। রিমি নিঃসন্দেহে একটা পাঁচ ফর্মার উপন্যাস। অফসেটে ছাপা। চার কালারের কভার, কভার অার্টিস্ট ধ্রুব এষ। বইমেলায় ধ্রুব এষ নামটা এতবার মাইকে ঘোষণা হয় যে, মনে হয় লোকটাকে কোনো লোকই না, শুধু একজোড়া শব্দ। ধ্রুব এষ। বেশ। তিনি কোথায় থাকেন বা কোথায় থাকেন না! একবার দেখেছিলাম এক বইয়ের তাকে, রুপা চক্রবর্তীকে, কী যে সুন্দর লাগে এই চাকা এই চক্রবর্তী এই কবিতার বইটিকে, মনে মনে হয়, পড়ি অার পড়ি, ইচ্ছে হলেই পড়ি। গড়াগড়ি দিয়ে পড়ি। সারারাত কবিতার বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে-বসে এপাশ-ওপাশ করা রাত কি  যায় না অামার? শুনেছি রুপা চক্রবর্তী এখন কোনো স্টলে নেই, মুদ্রণ শেষ। রি-এডিশন চাই। পড়ব। ইচ্ছে হয়, ইচ্ছেটাই অার্ট। পড়তে ভাল্লাগে। ভাল্লাগাই বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকাটাই সংষ্কৃতি। তাহলে এতবছর পরেও অাজ বলতে হয় ‘কী রকম ভাবে বেঁচে অাছি?’

একে তো ফাল্গুনের চাপ, তার উপরে অাবার কিছুকাল ধরে ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন বলে একটা এডিশনাল প্রেসার শুরু হয়ে গেছে, এই বাংলায়। সেই চাপও নিতে হচ্ছে, অামাদের, অামাকেও। চাপ অারো নিতে চাই। মেলায় অাসছে লিটল লিটল মেঘ, মেঘগুলো খুব দেখতে লাগে ভালো, মেলায় কবি-লেখকদের কাঁচা-কাঁচা বইগুলো স্বশরীরে এসে ছুঁয়ে-ছেনে-চটকে দিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। ব্যাপারটা পরোক্ষভাবে হলেও কবি-সাহিত্যিকদের পক্ষেই যাচ্ছে। খারাপ না। চলতে পারে। চলুক। মেলায় রঙিন শাড়ি পরে যে মেয়েগুলো অাসে প্রতিদিন, তাদের পুরষ্কৃত করা উচিৎ প্রকাশক ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের। বিনে পয়সায় এ কত বড় একটা জিনিস পাচ্ছে মেলার মহাজনরা, একবার ভাবেও না। অারো উল্টো বলে, মেয়েরা খালি ঘোরে, বই কেনে না। অারে, মেয়েদের বই কেনার কি অাছে? মেয়েরা কি জানে না, ছেলেরা বই লেখার নাম করে কী লিখে রেখেছে? মায়ের কাছে মাসির গল্প করে লাভ অাছে? সব মেয়েই জানে, ছেলেদের এত বাহাদুরির কিছু নেই, যতই গোঁফ ফুলিয়ে বাঘডাসা সাজুক, তারা, কোনো না কোনো নারীর পেট থেকেই বেরিয়েছে। তারপর হামাগুড়ি দিতে দিতে সেই মা-নারীর ভালোবাসায়-সহযোগিতায় হাঁটা-চলা-খাওয়া শিখেছে। তাই মেয়েরা যে বইমেলায় ফুলে ফুলে সেজেগুঁজে অাসে, নিমন্ত্রণ ছাড়াই অাসে, এসে বইগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, এ অনেক বড় কিছু। এ অামি পেতেই চাই। কারণ, অামি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখেছি, স্বাভাবিক থাকি না। থাকতে পারি না। কারণ, এত সুন্দর কবিতার বই অামার সামনে, অামার তাকে পড়তে ইচ্ছে করে, অামার তাকে ধরতে ইচ্ছে করে, অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে। অামার তাকে ছুঁতে ইচ্ছে করে, তার পাশেই তো শুতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটাই অার্ট, ইচ্ছেটাই কবিতা। ইচ্ছেটাই ছবি। ছবি ইচ্ছে করে, কবিতা ইচ্ছে করে, সবই ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে তোমার সঙ্গে সর্বাঙ্গে মাখামাখি করি, অর্থাৎ তোমাকে পড়ি, তুমি কাব্যগ্রন্থ, একদিন তুমি তাকে তাকে সাজানো থাকবে, কাচের ওপাশে, দেয়াল ঘেঁষে। তীব্র পাঠক অামি, পড়তে পড়তে জীবন অামার যাক, কামনা করি। বইও মাঝেমধ্যে বানান ভুল করলে বউ হয়ে যায়। নতুন বই তো নতুন বউ। ভাঁজ না ভাঙা। নতুন একটা গন্ধ। ভাল্লাগে। ভাল্লাগলে কী করব?

ইচ্ছে নিয়ে ঘুরে বেড়াই বইমেলায়, ফাল্গুনবেলায়, ও বউ তুমি বর্ণমালা, তোমাকে অামি পড়ব দিবানিশি…

লেখক: কবি ও নির্মাতা

মন্তব্য