groom_market_313ভারতের বিহার রাজ্যে চলছে মেয়েদের সুপাত্রের খোঁজে বর ‘পাকড়াও’ অভিযান। কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র না পেয়ে বেছে নিচ্ছেন সহিংস পন্থা। ভাড়াটে লোকজন দিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে পাত্র অপহরণ করে এনে বিয়ে দিচ্ছেন মেয়ের সাথে। এখন প্রশ্ন হলো এই আধুনিক সভ্য যুগে মেয়েদের জন্য সুপাত্র যোগাড় করতে এমন অসভ্য পন্থা বেছে নেয়ার কারণ কী? কারণটা পরে বিশ্লেষণ করা যাক। তার আগে কয়েকজন হতভাগ্য পাত্রের কাহিনী শুনে আসি।

সোনু কুমার। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সামান্য কেরানীর চাকরি করেন এই যুবক। ছুটি কাটাতে এসেছিলেন বিহারে নিজ বাড়িতে। ছুটিশেষে রিটার্ন টিকিট কিনতে রেলস্টেশনে যাওয়ার পথে তিনি পড়ে গেলেন বর পাকড়াওকারীদের খপ্পরে। জনা চারেক মুখোশধারী লোক তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গাড়িতে তোলে। নিয়ে যায় নিকটবর্তী সহর্ষ গ্রামে। সোনু ভেবেছিলেন মুক্তিপণ আদায়ের জন্যই তাকে অপহরণ করা হয়েছে। কিন্তু সহর্ষ গ্রামে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে তিনি দেখেন সেখানে এক যুবতী তার জন্য অপেক্ষায় বসে। সাত পাঁকে বেঁধে স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নিতে হবে তাকে। সোনুর আর কোন উপায় ছিল না। তাকে বাধ্য হয়েই সেই মেয়েকে বিয়ে করতে হলো। এই বিয়ে সোনুর জন্য আনন্দ নয়, দুঃস্বপ্ন বয়ে এনেছে। কারণ মেয়েটিকে বিয়ে করে সুখি হতে পারেনি সে।

বিহারের বখতিয়ারপুর জেলার বাসিন্দা রনধীর কুমার। বয়স তার তখন কেবল ১৮ পেরিয়েছে। টিউশনি শেষে বাড়ি ফেরার পথে অপহূত হন হতভাগ্য এই যুবক। তাকে ধরে এনে সোজা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিয়ে দেয়া হয় এমন এক মেয়ের সাথে যাকে সে এর আগে জীবনে কোনদিন দেখেনি। বিয়ে শেষে তাকে ঐ মেয়ের গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে এই বলে হুমকি দেয়া হয়—সে যদি কখনো মেয়েটির কোন ক্ষতি বা তাকে পরিত্যাগ করে, তাহলে রনধীরের পুরো পরিবারকে খতম করে দেয়া হবে।

রনধীরের কপাল ভাল, পুলিশ জেনে যায় এ খবর। অপহরণকারীদের গ্রেফতার করে পুলিশ এবং ঐ বিয়েও বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে রনধীর তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে এখন বেশ সুখেই আছে।

সোনুর মতো শত শত যুবক এই বর পাকড়াওকারীদের শিকার হয়ে অপছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করে নিরানন্দ জীবন কাটাচ্ছেন। গত বছর বিহারে আড়াই হাজারেরও বেশি যুবক অপহূত হন, যাদের বন্দুকের নলের মুখে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। ২০০৯-এ অপহূতের সংখ্যা ছিল ১৩শর বেশি।

পাকড়াও হওয়া বর বিবাহিত জীবনে সুখি হন— এমন ব্যতিক্রমী নজিরও আছে। পাত্রকে জোর করে ধরে এনে মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার পর মেয়েটিকে মনে ধরে যায় বরের। সুখি দাম্পত্য জীবন কাটায় তারা। যেমনটি ঘটেছে মনোজ শাহর জীবনে। ২০ বছর আগে তাকে অপহরণ করে এনে বিয়ে দেয়া হয়েছিল এক মেয়ের সঙ্গে। বিয়ের পর ঐ মেয়ের প্রেমে পড়ে যান মনোজ। সুখি এই দম্পতির ঘরে আসে দুটি ফুটফুটে মেয়ে।

মনোজের মতই আরেকজন ব্রহ্মাণন্দ ঝা। তাকেও জোর করে ধরে এনে বিয়ে দেয়া হয় পাত্রী মুন্নি দেবীর সঙ্গে। বিবাহিত জীবনে সুখি হলেও এই দম্পতি ‘বর পাকড়াও’ প্রথার ঘোর বিরোধী। ঝা বলেন, এই জঘন্য প্রথা থেকে সমাজকে যত শীঘ্র সম্ভব মুক্ত করতে হবে। তার স্ত্রী মুন্নীও মনে করেন, প্রত্যেক মানুষকে তার জীবন সঙ্গী বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত। বিয়ে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার মতো কোন বিষয় নয়।

ভারতের অন্যান্য রাজ্যে কিংবা বিশ্বের অন্য কোথাও পাত্র অপহরণের এমন ঘটনার নজির বিরল। বিহারে পুরুষের কি এতোই আকাল পড়েছে যে সেখানে পাত্রের জন্য এত ক্ষেপে উঠেছে লোকজন? পরিস্থিতি বরং উল্টো। ২০১১ সালের আদম শুমারিতে দেখা গেছে, বিহারে প্রতি ১ হাজার ছেলের জন্য মেয়ে আছে মাত্র ৭৫১ জন। পুরুষ সংকট তাহলে সমস্যা নয়, সুপাত্রের অভাবই মূল সমস্যা। মধ্যপুরা জেলার পুলিশ চিফ আনন্দ কুমার সিং জানালেন, ভুমিহার ও যাদব সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই বর পাকড়াওয়ের প্রবণতা বেশি। অনেকে মনে করেন, দারিদ্র্যতার পাশাপাশি অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অশিক্ষা, পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি, জাতিগত বৈষম্য সেখানকার মানুষকে ক্রমশ হিংস্র করে তুলেছে। সর্বোপরি সেখানকার সমাজে প্রচলিত যৌতুক প্রথা বর অপহরণের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। মেয়েকে পাত্রস্থ করতে গিয়ে মোটা অংকের অর্থ যৌতুক হিসাবে ছেলেকে দিতে হয় পাত্রীপক্ষকে; যেটা দরিদ্র এই জনগোষ্ঠীর পক্ষে দিন দিন দুরূহ হয়ে উঠছে। ফলে বিকল্প হিসেবে ‘বর পাকড়াও’কেই বেছে নিচ্ছেন অনেকে। – সূত্র অনলাইন

মন্তব্য