উন্নয়নে ৩২.৫০, সরকারের খরচ ৬৭.৫ ভাগ
ঢাকা : ২০১৬-১৭ সালের প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে উত্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। টাকার অংকে বাজেটের আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০০ কোটি (সম্ভাব্য) টাকার। এ বাজেটের মাত্র এক তৃতীয়াংশ (৩২ দশমিক ৫ শতাংশ) বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করার প্রস্তাবনায় দেয়া হয়েছে। বাকি অংশ (৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ) ব্যয় হবে সরকারের খরচের খাতে; যার মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সঞ্চয়পত্র ও দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এমন সব খাতে খরচ বাড়ানো উচিত যেখান থেকে সত্যিকার অর্থে সরকার লাভবান হবে। কিছু কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো আসলে কোনো কাজেই আসছে না। এগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। সরকারের উচিত উদ্যোক্তাদের আকর্ষণ করে এমন কিছু করা। এমন সব জায়গায় উন্নয়ন করতে হবে যেখান থেকে আসল প্রবৃদ্ধি আসবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইকোনমিক জোন, যোগাযোগসহ কয়েকটি খাতকে বিশেষ বিবেচনায় গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগের রাস্তা তৈরি করতে হবে। এতে করে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. খন্দাকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলামেইলকে বলেন, ‘বাজেটের আকার যেহেতু বাড়ছে সেখানে ব্যয়ের খাতও বাড়বে। তবে ব্যয় করার পূর্বে যাচাই-বাছাই করা উচিত, প্রকৃত অর্থে ব্যয় কোথায় কোথায় করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর বিশ্লেষণ করে বলা যাবে কোন খাতে কি যাবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বীরুপাক্ষ পাল বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রে সরকারের এতো ছাড় দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন নয়। ১১ শতাংশ সুদে টাকা বিনিয়োগ করছে মানুষ। এর ফলে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে ডিপোজিট সংগ্রহ করছে না। এর রেট একেবারেই পড়ে গেছে। কিন্তু কমাতে পারছে না ঋণের সুদ হার। তাদের কাছে অলস টাকা পড়ে রয়েছে, বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগের রাস্তা তৈরির জন্য সরকারকে এতো উচ্চমূল্যে সঞ্চয়পত্র কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি কিছু বিষয়ে যেমন রাস্তাঘাট, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আরো কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে। পরিবেশ দিতে হবে বিনিয়োগের। এর জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাসের উন্নয়নেও কাজ করতে হবে।’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সরকারের এমন কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। সেগুলো টেনে নেয়ার কোনো মানে হয় না। এগুলো হয় বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে, নয়তো কীভাবে এখান থেকে খরচের বিপরীতে লাভ নিয়ে আসা যায় সে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আসন্ন বাজেটে উন্নয়ন বরাদ্দ হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ও পদ্মা সেতুর গুরুত্ব বিবেচনায় এডিপির বরাদ্দে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে পরিবহন খাত। পদ্মা সেতুতে ৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এই খাতের সার্বিক উন্নয়নে মোট ২৮ হাজার ৫০৩ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বাস্তবায়নের জন্য মোট এক হাজার ১৪১টি প্রকল্প রাখা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার একটি বিনিয়োগ প্রকল্প, ১৩৩টি কারিগরি সহায়তার এবং অন্যান্য সাতটি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়ন ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। বাজেটে বরাদ্দ ও নিজস্ব বরাদ্দ মিলে এডিপির আকার দাঁড়াবে ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।
জানা গেছে, এডিপিতে এরপরই বড় বরাদ্দ রয়েছে শিক্ষা খাতের উন্নয়নে। এ খাতে ১৪ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর পর ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর বিদ্যুৎ খাতে ১২ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা এবং পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতে প্রায় ৮ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে যে টাকা থাকবে তা গুরুত্ব বিবেচনা করে বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে ব্যয় করা হবে।
এদিকে দিন দিন সরকারের খরচের হাত বাড়ছেই। চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ঋণ নেয়নি ঠিকই, তবে জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার। ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে টাকা না নিলেও সঞ্চয়পত্র থেকে যে টাকা নিয়েছে বা নেয়ার চিন্তা করছে তার জন্য সরকারকে ব্যপক সুদহার গুণতে হচ্ছে এবং হবে। সঙ্গে রয়েছে বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের সুদ। আগামী বাজেটেও সেখান থেকে ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
অষ্টম জাতীয় পে-স্কেলে বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে বেতন ভাতা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা সরকারের খরচের একটি অন্যতম বড় খাত। তবে সরকার বিভিন্ন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে এ খরচ অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে বলেও মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদরা। সব মিলিয়ে আসন্ন বাজেটে সরকারের এসব বিষয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
আর এসব খরচ মেটানোর জন্য রাজস্ব থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। রাজস্ব বহির্ভূত আয়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট আয়ের টার্গেট ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। যে ঘাটতি মেটানো হবে ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ, বিদেশি ঋণ ও সাহায্য থেকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ও গবেষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেটের ব্যয়টা করা উচিত। আমরা বারবার বলে আসছি- ভৌত অবকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে যাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এ খাতগুলো কয়েকবছর ধরে বরাদ্দ কম দেয়া হচ্ছে।’ সাশ্রয়ী সময়ে ও সুশাসনের ভিত্তিতে বাজেটের বরাদ্দগুলো কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন এ গবেষক।