চারুকলার দেয়ালের পাশেই আমার শেখানোর জায়গা

2016_06_03_16_46_17_QnBs2S9ISX7fvvCe7UFVe8qrJeg1xL_original

শিল্পীমুখ- শিল্পীদের ভাবনা, কাজ আর কথার আয়োজন। আনকোরা, অভিজ্ঞতা বেশ খানিকটা কিংবা শিল্প নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন এমন কেউ – তাদের কাজ, শিল্পকে ঘিরে ভাবনা নিয়েই হাজির হয়েছি আমরা। ‘শিল্পীমুখ’ আয়োজনে আজকের শিল্পী এমন একজন যিনি বাঁশি নিয়ে মেতে থাকেন সারাক্ষণ। শাহবাগের চারুকলার রাস্তার ধারের চেনা মুখ  বাঁশির কারিগর লাবু মিয়া। পরিচিতদের কাছে যিনি লাবু ভাই। আড্ডা হয়েছিল তাঁর সাথে। আড্ডার অংশবিশেষ বাংলামেইলের পাঠকের জন্য।

বাঁশি বাজানো আর বানানো কবে থেকে, কি করে শুরু হল?

  • পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বাঁশি বাজাই। আমার বাবা, খেকু মিয়া, সেই বৃটিশ আমল থেকে বাঁশি বাজাতেন। তিনি ছিলেন বৃটিশদের সৈন্যবাহিনীতে সৈনিক। তখন থেকেই সেনাবাহিনির অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজাতেন চাকরীর পাশাপাশি। এরপর তো দেশ ভাগ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ব-পাকিস্তান বাংলাদেশ হল। আমি মূলত ৭৫’র পর থেকেই আছি এ লাইনে। আমার বাবাও ২০১১ সাল পর্যন্তই বাঁশি নিয়ে ছিলেন। তিনিই আমাদের দুই ভাইর হাতে এই বাঁশি তুলে দিয়ে যান। শৈশব-কৈশোর আমার ঢাকাতেই কাটে। বাঁশি বাজিয়ে, বাঁশি বানানোর ব্যবসা করেই চলি।

বাঁশি ছাড়া আর কোন্‌ কোন্‌ যন্ত্র বানানোর বা বাজানোতে আগ্রহী আপনি?

  • মূলত মানুষ আমাকে আমার বাঁশি দিয়েই চিনে। তবে এর পাশাপাশি ঢোল, একতারা, ডুগডুগি এগুলোও বানাই। আমার ভাই লাল মিয়া সহ আমাদের পরিবারের সবাই ই আমরা মিলেমিশে যন্ত্র বানানোর এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করি। এগুলো জানার জন্য আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। সেই পাহাড় থেকে বাঁশ কাটা হয় চৈত্র-ফাল্গুনের দিকে। তখন বাঁশ এনে ভাগ ভাগ করে ড্রাই করার কাজ করতে হয়। এরপরও অনেক ধাপ।
  • আমার তিন ছেলে , দুই মেয়ে আর আপনার ভাবী সবাই মিলেই কাজটা শেষ করি আর কি। ছেলে মেয়েরা চাকরী পড়াশোনার পাশাপাশি এই কাজও করে।

পেশা হিসেবেই যেহেতু নিয়েছেন বাঁশি বাজানো আর বানানোকে। তাই জানতে চাই এ ক্ষেত্রে পেশাদারীত্বের অবস্থা কি?

  • আমি ১৯৯৯-২০০২ সাল পর্যন্ত শেরাটনে বাঁশি বাজিয়েছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও কাজ করছি, করেছি। প্রশ্নটা হল পেশাদারীত্ব আসবে কি করে বলেন। সরকার বা ধরেন যারাই অনুষ্ঠান করছেন তারাই আসলে বাঁশির মূল্যায়ন করছেন না সঠিকভাবে। শিল্পকলা একাডেমি যদি কেবল ঢাকা না সারা দেশের বিভিন্ন জেলা আর বিভাগ থেকে যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে এসে নিয়মিত উৎসব করতো তবে অনেকে উঠে আসতো। ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেককে চিনি জেলা পর্যায়ে যারা দারুণ বাজান। অনুষ্ঠানগুলোতেও যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের তুলনামূলকভাবে সম্মানী কম দেওয়া হয়। এটার দিকেও যদি লক্ষ্য রাখা হয় তবেও কিন্তু শিল্পীরা অনেকটাই লাভবান হবেন।

দেশীয় যন্ত্র সঙ্গীতে পাশ্চাত্যের প্রভাবকে কেমন ভাবে দেখেন আপনি ?

  • বাঁশের যে বাঁশি আমি বানাই এটার রিদম স্বতন্ত্র। দেখুন স্বকীয়তা একটা মানুষের হৃদয়ে স্পন্দন জাগাতে পারে বলে আমি মনে করি। মানুষ এখন পাশ্চাত্যের যন্ত্রের প্রতি ঝুঁকছে। কিন্তু আমার মাঝে বাংলার নিজস্ব ঢোল, বাঁশের বাঁশি এগুলো অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। হরিপ্রসাদ চৌরাশিও তো বাঁশের বাঁশিই বাজাচ্ছেন, বাজাতে জানলে এ যন্ত্র মন ছুঁয়ে যেতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।

একাডেমিক পর্যায়ে যন্ত্র সঙ্গীত শেখানোর ইতিবাচক আর নেতিবাচক দিক কি বলে মনে হয় ?

  • ভালো লাগা এটা যে একাডেমি আছে এবং নতুন নতুন হচ্ছে এই দেশে। আমার মনে হয় যে দেশে যত বেশি সংস্কৃতির প্রভাব থাকবে সে দেশ তত হত্যা-দাঙ্গামা থেকে দূরে থাকবে। সুন্দর মনই পরমের সন্ধান পায়।

    নেতিবাচক ঠিক না, তবে পাশ্চাত্য যন্ত্রের ব্যবহার যত শেখানো হয়। তত দেশীয় যন্ত্রের ব্যবহার শেখানো হয় না। এটা বৃদ্ধি করা গেলে অন্য রাষ্ট্রের কাছে এই যন্ত্রের মাধ্যমেই আমাদের দেশের পরিচিতি তুলে ধরা সম্ভব। আমি শেখানোর চেষ্টা করি। অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ের এখন বাঁশির প্রতি ঝোঁক আছে। কিন্তু আমার সামর্থ্যে কুলোয় না। চারুকলার দেয়ালের পাশেই আমার শেখানোর জায়গা। দেশজ যন্ত্রকে প্রাধান্য দিলে ভালো হয়।

বর্তমান অবস্থা কি মনে হয় বাঁশি বাজানোর চর্চার ক্ষেত্রটিতে?

  • এটা দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। ভালোর দিকে এগোচ্ছে আমি বলবো। যদি যন্ত্র-সঙ্গীতের গবেষণা যারা করেন তারা এবং সরকার এ বিষয়টিকে যথার্থভাবে তুলে ধরেন তাহলে আরও অনেক ছেলেমেয়ে আগ্রহী হবে। এ শিল্প বিস্তার লাভ করবে। সরকার আগামীতে যদি উদ্যোগ নেন তবে ভালো। জানি না কতদিন বাঁচবো। এই বাঁশি নিয়ে ভারত-পাকিস্তানসহ বাইরের দেশে গিয়েছি। ইচ্ছা ছিল আগামী প্রজন্মের অন্তত একজন যেন পাই যে এটা ধরে রাখবে। জানি না কেউ রাখবে কি না ধরে এই ব্যবসাটা। তবু বাঁশিই সব আমার।

মন্তব্য