রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঘাটতি
হায়দার আকবর খান রনো :
বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে গণমাধ্যমে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। হওয়াটা স্বাভাবিকও বটে। কারণ, বর্তমানে খুবই বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকলেও দলটি যে বড় দল এবং এখনো যথেষ্ট সমর্থক আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কাউন্সিলের নামে যা হয়েছে, তা আগে থেকেই জানা। তিন হাজার ডেলিগেটের এক দিনের সম্মেলন বস্তুত একটি জনসভা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। প্রধান দুই পদে চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট যথাক্রমে বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমান আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। বাকি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে কাউন্সিলে নির্বাচিত হবেন না, সেটাও আগেই বলা হয়েছিল। তাহলে ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের তাৎপর্য কী?
যেকোনো রাজনৈতিক দলের নিয়মিত কাউন্সিল বা সম্মেলন, অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বমূলক সমাবেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুটি বিষয়—দলের রাজনৈতিক লাইন বা কর্মসূচি ও নেতৃত্ব নির্বাচন। আমাদের দেশে বড় রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে প্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকাই থাকে না। এসব দল একক নেতৃত্বের পার্টি। এবং সেই প্রধান নেতা বা নেত্রীই পরবর্তী সময়ে ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় কমিটি ও সর্বোচ্চ সংস্থা। বিএনপির এবারের সম্মেলনেও তা-ই হয়েছে। জেলা-গ্রাম-গঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা ডেলিগেটদের কাজ হলো নেতা-নেত্রীর বন্দনা করে স্লোগান দেওয়া। হয়তো গ্রামাঞ্চলের কর্মীরা ঢাকায় এসে উৎসাহবোধ করেন। আর নেতৃত্ব জমায়েত দ্বারা সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন করে থাকেন। সেদিক থেকে এবারের বিএনপির সম্মেলন হয়তো দলের জন্য লাভজনক হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দলটি মাঠেই নামতে পারছিল না। কর্মীরা মামলা-মোকদ্দমায় পর্যুদস্ত। এই সম্মেলন হয়তো তাঁদের কিছুটা চাঙা করবে।
কিন্তু দেশবাসী কী পাবে? দেশবাসী দেখল সেই পুরোনো নেতৃত্ব, খালেদা জিয়ার একটি বক্তৃতা, যার মধ্যে জনগণের পক্ষে কোনো কর্মসূচি নেই, আশান্বিত করার মতো চমকও নেই। বড় দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনগুলোয় দলের রাজনৈতিক লাইন নিয়েও আলোচনা হয় না। বিএনপির সদ্য সমাপ্ত কাউন্সিলে বিগত ছয় বছরে দলের কার্যকলাপ, আন্দোলন, ব্যর্থতা ইত্যাদি বিষয়ে কোনো পর্যালোচনা হয়নি। তেমন সুযোগও ছিল না। দরকারও নেই। চেয়ারপারসনের ইচ্ছার বাইরে কোনো কথা বলার অথবা সমালোচনা করার অধিকার ও সুযোগও ছিল না। এসব দলে তা থাকেও না।
ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কী বলা হবে, তা এখন থেকেই অনুমান করা যায়। উন্নয়নের ফিরিস্তি থাকবে। প্রতিপক্ষের সমালোচনা হবে। কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে বিতর্ক, তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা—এসব দরকার নেই।
কমিউনিস্ট পার্টি বা এ ধরনের আদর্শভিত্তিক সুসংহত দলের নিয়মিত কংগ্রেসে বা সম্মেলনে কমপক্ষে দুই-তিন মাস আগে থেকে রাজনৈতিক প্রতিবেদন, প্রস্তাব, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচিতে সংশোধন ইত্যাদি ছাপানো আকারে পাঠানো হয় সব সদস্যদের কাছে। নিম্নতর ইউনিটসমূহে আলোচনা হয়, বিতর্ক হয়, মতামত সংগঠিত হয়। নিম্নতর ইউনিটও সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে; রাজনৈতিক মতামত, এমনকি ভিন্নমতও প্রকাশ করে। গোটা পার্টিতে রাজনৈতিক লাইন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এটাই তো গণতান্ত্রিক নিয়ম। অথচ বড় দলের মধ্যে সামান্যতম গণতান্ত্রিক চর্চা নেই।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র বিএনপির চেয়ে কিছুটা গণতান্ত্রিক। সেখানে সাধারণ সম্পাদক সম্মেলনে নির্বাচিত হন। বিএনপিতে চার বছর ধরে একজন সাধারণ সম্পাদকই নেই। মির্জা ফখরুল ইসলাম এখনো ভারপ্রাপ্ত। সেই দলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নামে একটি বিশেষ পদ রয়েছে। তিনি দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। এবং সেই পদ অলংকৃত করে আছেন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, যাঁর না আছে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, না আছে অভিজ্ঞতা।
বড় বড় রাজনৈতিক দলে পরিবারতন্ত্র এখন ভারত ও পাকিস্তানেও আছে। এত বড় বিশাল ভারতবর্ষে যেখানে এত যোগ্য নেতৃত্ব রয়েছেন, সেখানেও কংগ্রেস দলের প্রধান ব্যক্তি নেহরু পরিবারের বাইরে ভাবা যায় না। পাকিস্তানের উদাহরণ আরও খারাপ। বেনজির ভুট্টো উইল করে গেছেন কে হবেন তাঁর উত্তরাধিকার। যেন দলটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বেনজিরের অবর্তমানে পিপলস পার্টির প্রধান হবেন তাঁর ছেলে। অনেকটা একই ধরনের মানসিকতা নিয়েই খালেদা জিয়াও তাঁর ছেলেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন বানিয়ে রেখেছেন। বলাই বাহুল্য, বিএনপিতে অনেক অভিজ্ঞ যোগ্য নেতা থাকলেও দলে তাঁদের মূল্য নেই। এমনকি মহাসচিবও মূল্যহীন।
কাউন্সিলে খালেদা জিয়া বলেছেন, এবার ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনবেন। তবে সেটা কীভাবে এবং সংবিধানে কী ধরনের সংশোধন হবে, তা জানানো হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে একক সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় (২১ মার্চ ২০১৬)। খালেদা জিয়ার যদি সত্যিই উপলব্ধি হয়ে থাকে যে সব সময় ক্ষমতা একক ব্যক্তির (প্রধানমন্ত্রীর) হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া গণতন্ত্রের পরিপন্থী, তাহলে সেটা ভালো কথা। কিন্তু তাঁর ক্ষমতায় যাওয়া তো এখনো বেশ দূরের বিষয়। আপাতত তিনি তো দলের মধ্যেও ভারসাম্য আনতে পারতেন। আনেননি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই পদে খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ও ইচ্ছা নেই। এমনকি কে হবেন মহাসচিব, তা পুরোটাই চেয়ারপারসনের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। দলের মধ্যে যাঁরা গণতান্ত্রিক চর্চা করতে পারেন না, কীভাবে আশা করব যে সেই নেতৃত্বই দেশকে গণতন্ত্র উপহার দেবেন?
দেশে যদি তিনি সত্যি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাহলে তাঁর আগের শাসনামলের অগণতান্ত্রিক কাজগুলোর (যথা অপারেশন ক্লিনহার্ট এবং এই অপারেশনে যাঁরা নির্যাতন ও হত্যা করেছেন, তাঁদের আইন করে দায়মুক্তি দেওয়া) জন্য আত্মসমালোচনা করতেন। ভারতের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন জরুরি আইনে বাড়াবাড়ি করার জন্য। সে জন্য তিনি জনগণের সামনে হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘ম্যায় মাফি মাংতা হু।’ এমন স্বীকারোক্তি আমাদের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে অনুপস্থিত।
ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি কিন্তু ছোট দল নয়। পশ্চিমবঙ্গে তারা তিন দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ছিল। তারা তাদের গঠনতন্ত্রে এই সংযোজনী এনেছে যে কোনো একক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি পার্টির সাধারণ সম্পাদক থাকবেন না। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে—দুই মেয়াদের বেশি কেউ পার্টির সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক থাকবেন না। পরাধীন ভারতে কংগ্রেসের বিধান ছিল পরপর দুই মেয়াদের (দুই বছর, কারণ প্রতিবছর কংগ্রেস অধিবেশনের নিয়ম ছিল) বেশি পার্টির সভাপতি পদে দাঁড়াতে পারবেন না। যুক্তরাষ্ট্রেও প্রেসিডেন্ট পদে কেউ দুবারের বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। সেখানেও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দলের মধ্যে তুমুল আলোচনা ও ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচিত হন। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলের ক্ষেত্রেই তা সত্য।
দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যের উন্নত পুঁজিবাদী দেশে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা এখনো আমাদের দেশে অনুপস্থিত। আমরাও গণতন্ত্রের জন্য বড় বড় সংগ্রাম করেছি। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধও ছিল এক অর্থে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম। তারপরও আমাদের সংস্কৃতিতে, মানসিকতায় সামন্তবাদের জের রয়ে গেছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি।
২০০৭-০৮ সালে অদ্ভুত ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অগণতান্ত্রিক সরকার ছিল বটে। কিন্তু তারা যে রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল, তার সবটাকে খারাপ বলা যাবে না। তাদের অপরাধ ছিল, তারা জোর করে সংস্কার চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। আসলে রাজনৈতিক দলের সংস্কার দলের নেতৃত্ব বা কর্মী ও সমর্থক জনগণের কাছ থেকে আসতে হবে। যত দিন দলে গণতন্ত্র থাকছে না, তত দিন সেসব দল দেশেও গণতন্ত্র আনবে না। এসব অগণতান্ত্রিক দলের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো একনায়কতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন। আমি বিএনপিকে সমালোচনা করছি বলে যে বর্তমানের শাসক আওয়ামী লীগকে সমালোচনার বাইরে রাখছি, তা নয়।
উভয় দলই অগণতান্ত্রিক আচরণ করে আসছে। উভয় দলই ধনিক শ্রেণির স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। আওয়ামী লীগের ‘ভিশন-২০২১’-এর অনুরূপ বিএনপিও রূপকল্প ২০৩০ পেশ করেছে। কিন্তু শ্রমিকের মজুরি, কৃষকের ন্যায্য অধিকার, গরিব মধ্যবিত্তের জন্য চিকিৎসা ও শিক্ষা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি বিষয় কোনো দলেরই কর্মসূচিতে নেই। গণতন্ত্র ও আর্থসামাজিক কর্মসূচির বিচারে দুইয়ের মধ্যে বড় রকমের পার্থক্য নেই। তবু পার্থক্য যে আছে, সেটা উল্লেখ করা দরকার। আওয়ামী লীগ সরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করেছেন। আর ঠিক এই প্রশ্নেই বিএনপির অবস্থান যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে যায়। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুর জন্য কাউন্সিলে শোকপ্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দলটি এখনো জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ।
আসলে আমাদের দেশের প্রভাবশালী দলগুলো আত্মসমালোচনাও করতে জানে না; বরং আত্মদম্ভে ভোগে। সে জন্য তারা নেগেটিভ ভোট পেয়ে নির্বাচনে জিততে চায়, কিন্তু জনগণকে নিয়ে কার্যকর আন্দোলন করতে পারে না। বিএনপির ব্যর্থ আন্দোলন থেকে এই শিক্ষাটুকু তারা নিয়েছে কি না, জানি না।
বিএনপি এখনো প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বা সরকারের প্রতিপক্ষ। সে জন্য দলটি সম্বন্ধে এত আলোচনা। আসলে সব দলেই গণতন্ত্র চর্চার জন্য দলের ভেতর থেকে চাপ থাকা দরকার। সেটা শাসক দল আওয়ামী লীগ, সামরিক স্বৈরশাসকের দল জাতীয় পার্টি বা কয়েকবার ক্ষমতায় আসা বিএনপি—কোথাও নেই। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে তা দারুণভাবে অনুপস্থিত রয়েছে। নতুন প্রজন্মকে নতুন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগী হতে হবে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি দরকার শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রে, এমনকি পারিবারিক জীবনেও। কিন্তু সামগ্রিক গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ সৃষ্টি করতে না পারলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভালো কিছু আশা করতে পারি না।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।