চায়ের কাপে সিগারেটের কৌশলী বিজ্ঞাপন

2016_05_21_22_08_28_m1kCo2LYhEXL6lptwKVSahkOOtkZFl_original

ঢাকা: চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার আগেই নজরে আসবে সিগারেটের বিজ্ঞাপনটি। লোভ জাগবে ধূমপানের। যারা মনে মনে সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারাও চা খাইতে গেলে নিজের অজান্তেই দোকানির কাছে ওই ব্র্যান্ডের একটা সিগারেট চেয়ে বসতে পারেন!

চায়ের কাপে এমন বিজ্ঞাপন দেখা গেছে রাজধানীর রমনা থানার সামনের একটি দোকানে। কাপে সাঁটানো রয়েছে উইনস্টোন (winston) সিগারেটের বিজ্ঞাপন। কিছুক্ষণ থাকতেই দেখা গেল, চায়ের চুমুক দিয়ে বিজ্ঞাপন দেখে দোকানির কাছে ওই ব্র্যান্ডের সিগারেট চাইলেন এক ক্রেতা। তিনি ওই ব্র্যান্ডের সিগারেট খান না। তাছাড়া সম্প্রতি ধূমপান ছাড়ার চিন্তা করছেন।

আজমাইন মাহতাব নামে ওই ব্যক্তি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।  তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাস দুয়েক হলো ধূমপান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কিন্তু যখনই চায়ে চুমুক দেয়ার পর বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়লো তখনই তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে একটি সিগারেট ধরালেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বিলবোর্ড বা গ্যাসলাইটারে নয়, কৌশলে চায়ের কাপে এমন বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। বিজ্ঞাপন দেয়া সিগারেটটির গায়ে লেখা রয়েছে ‘ম্যানুফ্যাকচারড আনডার অথরিটি অব জে টি ইন্টারন্যাশনাল এসএ, সুইজারল্যান্ড’। সিগারেটের প্যাকেটটির গায়ে মন্ত্রণালয় নির্দেশিত সতর্কতার কোনো ছবিও নেই। শুধু লেখা রয়েছে ‘ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’।

রাজধানীর রমনা, শাহবাগ, নিউমার্কেট, আজিমপুর, ধানমন্ডি ও মোহাম্মাদপুরের বেশিরভাগ চায়ের দোকানে কাপে দেখা গেছে উইনস্টোন সিগারেটের এমন বিজ্ঞাপন।

এ ধরনের বিজ্ঞাপন আইননত দণ্ডনীয় অপরাধ, এ বিষয়ে ওইসব দোকানির কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, কোম্পানির পক্ষ থেকেই সেলসম্যানরা এই সব চায়ের কাপ দিয়ে গেছে। বলেছে, ক্রেতাদের এই সব কাপে চা খাওয়াতে।

শুধু চায়ের কাপেই নয়, রাজধানীর মোড়ে মোড়ে সিগারেটের প্যাকেট সদৃশ বাক্স দোকান চোখে পড়ে। ওইসব দোকানির সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন টোবাকো কোম্পানির পক্ষ থেকে বিনামূল্যে তাদের ওই সব বাক্স দোকান বানিয়ে দেয়া হয়েছে।

এছাড়াও রাজধানীর  বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা যায়, গ্যাসলাইটারে সিগারেট কোম্পানির লোগো দেয়া এমনকি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ দোকানে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সামনের দিকে সিগারেট সাজিয়ে রাখা হয়।

তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্টের ন্যাশনাল এডভোকেসি অফিসার সৈয়দা অনন্যা রহমানের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫ নম্বর সেকশনে ১ এর ক তে স্পষ্ট বলা আছে, তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেয়া যাবে না। যদি কেউ দেয়, সেক্ষেত্রে তার ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড, অন্যথ্যায় ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এমনটি উভয় দণ্ডেও কেউ দণ্ডিত হতে পারেন।’

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন উন্নয়ন কমিটির সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল আলম বাংলামেইলকে বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বা অন্য যে কোন উপায়ে তামাকজাত পণ্যে লোগো বা তাদের নমুনা ব্যবহার নিষিদ্ধ।’

তারপরেও তো চলছে এ ধরনের বিজ্ঞাপন, এগুলো বন্ধে করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই সমস্যার সমাধানের পথ একটাই। সেটা হচ্ছে সরাসরি কোম্পানিকে শাস্তি দিতে হবে। এখন যেটা করা হয় সেটা হচ্ছে তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়ার অপরাধে দোকানিদের শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট নয়।’

এ ধরনের প্রচারণার বিষয়ে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের (এনটিসিসি) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বাংলামেইলকে বলেন, ‘এটি সরাসরি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরোধী। এই আইন ভঙ্গকারীর জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা  রয়েছে।’

তামাক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সম্প্রতি সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, বহুজাতিক তামাক কোম্পানিতে সরকারের অংশীদারিত্ব বাতিল করার এক্ষুণি উপযুক্ত সময়। যখন সরকারই ব্রিটিশ অ্যামেরিক্যান টোবাকোর (বিএটিএ) ১৩ শতাংশের অংশীদার তখন কোনোভাবেই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, বিএটিএ বোর্ড পরিচালকদের আসনেও আছেন আমাদের দেশের মন্ত্রী-সচিবরা। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে হলে প্রথমেই বিএটিএ’র অংশীদারিত্ব থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ দেন সাবেক এ বিসিবি পরিচালক।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় সোয়া ৪ কোটি মানুষ তামাক সেবন করে। এতে ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, এজমাসহ নানাবিধ প্রাণঘাতি রোগ সৃষ্টি হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদন মতে, তামাকখাতে যেখানে সরকারের বছরে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় হয়, সেখানে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা, অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ফলে বছরে নিট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

মন্তব্য