গুলশানের জিম্মি সঙ্কট, বিদেশিরাই টার্গেট

2016_07_02_12_21_50_ENs6MMuVHODbX9JvB4t4bgsaU9X2fU_original

ঢাকা: শুক্রবার সন্ধ্যা পর থেকে শনিবার বেলা দেড়টা পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সঙ্কটের সমাপ্তি ঘটেছে। সেনাকমান্ডোর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ এর মাধ্যমে সঙ্কটের শেষ। কিন্তু ইতিমধ্যে হারাতে হয়েছে ২২টি প্রাণ। অভিযানে নিহত হয়েছে ৬ অস্ত্রধারী। দুই জন শুক্রবার রাতেই হাসপাতালে মারা গেছেন। আর শনিবার রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২০ জন বিদেশির মৃতদেহ। এখনো সাত জনের মতো নিখোঁজ রয়েছেন।

গুলশান ২ এর ৭৯ নম্বর রোডের ৫নং বাড়ির দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত হলি আর্টিসান বেকারি রেস্টুরেন্টে হামলা চালায় অস্ত্রধারীরা। ওই রেস্টুরেন্টের বেশিরভাগ কর্মকর্তা কর্মচারীই বিদেশি। সেখানে খেতে আসেনও সাধারণত বিদেশিরা।

হামলার সময় বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বেঁচে আসা সুমন নামে এক কর্মচারী জানান, কয়েকজন তরুণ তলোয়ার ও পিস্তল উঁচিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ আওয়াজ দিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে। তারা বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং গুলিও চালায়।

হামলার খবর গণমাধ্যমে আসার কিছুক্ষণ পরেই (রাত ১০টা প্রায়) দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির লোকেরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। রক্তাক্ত অবস্থায় অনেককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। তাদের অনেকেই গুলি বা বোমার স্প্লিন্টার বিদ্ধ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন জন এবং পার্শ্ববর্তী ইউনাইটেড হাসপাতালে বাকিদের ভর্তি করা হয়। সেখানেই মারা যান বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন এবং ডিবি পুলিশের এসি রবিউল ইসলাম।

গুলি ও স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে এরা ‍দুজন নিহত হয়েছেন এমন খবর প্রথমে জানা গেলেও শনিবার হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে জানানো হয়, তারা গুলি নয় তারা স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

তবে ঘটনা গুলশান এলাকায় হওয়ার পরেও তারা কীভাবে ঘটনাস্থলে এলেন এবং স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেন সে ব্যাপারে এখনো সুস্পষ্ট কোনো তথ্য মিলছে না।

অস্ত্রধারীদের হাতে জিম্মিদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত করিম, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান শেষ পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। তার বরাত দিয়ে বাবা এন আর করিম জানিয়েছেন, অস্ত্রধারীরা বেছে বেছে অমুসলিমদের হত্যা করেছে।

জিম্মিদের মধ্যে আরো ছিল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মালিহা ও তার কয়েকজন বান্ধবী। রাত সাড়ে ১১টায় ওই ছাত্রীর বাবা বোরহান জানান, ফোনে মেয়ের সাথে কথা হয়েছে। বলেছে, ‘বাবা আমরা বিপদে, আমাদের বাঁচাও!’ তবে তারা আর জীবিত নেই বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে ঘটনার শুরু থেকেই লাইভ সম্প্রচার করছিল বেসরকারি টেলিভিশনগুলো। কিন্তু রাত সাড়ে ১১টার দিকে র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজির আহমেদ লাইভ সম্প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দেন। টিভিতে অনেক অসমর্থিত সূত্রে খবর প্রকাশের ফলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশঙ্কায় এ অনুরোধ করেন তিনি। অস্ত্রধারীদের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করা হবে বলে জানান তিনি। এরপর ঘটনার আর তেমন হালনাগাদ পাওয়া যায়নি। তবে দুয়েকটা টিভি তারপরও লাইভ দিয়েছে। শনিবার সেসব টিভির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

মধ্যরাতে নিরাপদ দূরত্বে থেকে লাউড স্পিকারে আত্মসর্ম্পণের আহ্বান জানানো হলেও সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনির সদস্যরা জানান, আলোচনা শুরু করতে তিনটি শর্ত দেয় সন্ত্রাসীরা। রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে চিৎকার করে এসব শর্তের কথা বলছিল তারা। শর্তগুলো হলো- রাজধানী ডেমরা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামা’তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা খালেদ সাইফুল্লাহর মুক্তি, রেস্টুরেন্ট থেকে তাদের নিরাপদে সরে যেতে দেয়া এবং ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে এ অভিযানের স্বীকৃতি।

জানা যাচ্ছে, রাতেই একাধিকবার উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হয়। তবে সন্ত্রাসীরা রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে গুলি ও বোমা ছুড়তে থাকলে আর সামনে এগোনো সম্ভব হয়নি। কিন্তু প্রস্তুতি চলতে থাকে।

আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি জিম্মি উদ্ধারে রেস্টুরেন্টে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শনিবার (২ জুলাই) ভোর পর্যন্ত আত্মমর্পণের জন্য অপেক্ষা করেও সাড়া না পাওয়ায় সেনাকমান্ডো অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে কমান্ডো অভিযান শুরু হয়। অভিযানে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি নৌবাহিনী, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং পুলিশের বিশেষ ইউনিট সোয়াত সদস্যরা অংশ নেয়।

কমান্ডো অভিযান শেষে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ভেতর থেকে এক বিদেশিসহ উদ্ধার করা হয়েছে ৫ জনের মরদেহ। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি।

অভিযান চলাকালে রেস্টুরেন্টের পাশে পুকুর পাড়ে খালি গায়ে ও প্যান্ট পরা ওই যুবককে দেখতে পায় পুলিশ। তখন তাকে ডাকা হলে সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন গুলি করে তাকে আটক করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ওই যুবকের বুকে গুলি লেগেছে। তবে ওই যুবকের পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।

পুরো অভিযান নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। এ নিয়ে আইএসপিআর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফিং করা হয় বিকেলে।

ব্রিফিংয়ে বলা হয়, সেনাবাহিনির প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে ৭টা ৪০ মিনিটে অভিযান শুরু করে ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যে সন্ত্রাসীদের নিমূল করে এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সকাল সাড়ে ৮টায় অভিযানের সফল সমাপ্তি ঘটে। অভিযানে ৩ বিদেশি নাগরিকসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। অভিযানে ৬ সন্ত্রাসী নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অভিযান শেষে তল্লাশি চালিয়ে ২০ জন বিদেশি নাগরিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যাদের অধিকাংশকেই ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে নৃশংসভাবে মানে গলাকেটে কি না সেটা সুস্পষ্ট করেনি আইএসপিআর।

সেখান থেকে ৪টি পিস্তল, একটি ফোল্ডেড বাট একে ২২, ৪টি অবিস্ফোরিত আইইডি, একটি ওয়াকিটকি এবং ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কেউ আহত হয়নি।

এদিকে শুক্রবার ঘটনার শুরু থেকেই বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো হতাহতের খবর হালনাগাদ দিতে থাকলেও বিদেশি পত্রিকাগুলো খবর সংগ্রহে এগিয়ে ছিল। দেশে যখন ওসি সালাউদ্দিনের মৃত্যুর খবরও নিশ্চিত করা যায়নি তখনই ইন্ডিয়া টুডেসহ বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যম বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ার খবর দেয়।

রাত ১২টার দিকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত আমাক এজেন্সির বরাত দিয়ে বিতর্কিত মার্কিন ওয়েবসাইট সাইট ইন্টেলিজেন্স জানায়, গুলশানের স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টটিতে আইএসই হামলা চালিয়েছে। হামলার দায় স্বীকার করেছে তারা। এতে আরো বলা হয়, ওই হামলায় তারা ২০ জনকে হত্যা করেছে। শনিবার যৌথ অভিযানের পর ঠিক ২০ জন বিদেশিরই মৃতদেহ উদ্ধার করা হলো!

মন্তব্য