ভূমিকম্পে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?

2016_04_27_11_17_37_CY1FrErFvWUbJOmcx9t6eiCp26QEXF_original

ঢাকা : ইদানিং রাজধানীতে ভর করেছে এক নতুন আতঙ্ক। শঙ্কিত মনে ভাবনা সবার, কখন যেন কেঁপে ওঠে পুরো ঢাকা শহর। এই বুঝি খসে পড়ে ইট-পাথরের দালানঘর। কিংবা ভূমিকম্পে টিকে থাকবে তো এই নগর!

বেশ কিছুদিন ধরে প্রকৃতিতে বয়ে চলা প্রচণ্ড তাপদাহে পোড়া রাজধানীবাসীর মনে যোগ হয়েছে আতঙ্কের এক নতুন মাত্রা। আর তা হলো ভূমিকম্প। যেন ভূমিকম্পের শঙ্কা নিয়েই এসেছে এবারের বৈশাখ।

দেশজুড়ে যখন চলছে বাংলা বর্ষবরণের প্রস্তুতি, ঠিক চৈত্রের শেষরাত ৭টা ৫৫ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল রাজধানীসহ সারাদেশ।

শুধু তাই নয়, এর আগের সপ্তাহেও বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার, এ বছরের ৪ জানুয়ারি ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পসহ চলতি বছরেই মোট ১৫ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। আর বিগত দু’বছরে বাংলাদেশ এবং তৎসংলগ্ন ভারত, মায়ানমার অঞ্চলে প্রায় ৫০টি মৃদু, মাঝারি ও উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প দেখা দিয়েছে।

এ ছাড়া দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভূমিকম্প অনূভূত হয়েছিল ৫১৬ বার।

এর মধ্যে ২০০১ সালে ৩১ বার, ২০০২ সালে ৪৩, ২০০৩ সালে ৪২, ২০০৪ সালে ৩৯, ২০০৫ সালে ৩০, ২০০৬ সালে ২৭, ২০০৭ সালে ৩১, ২০০৮ ৩৬, ২০০৯ সালে ৩৪, ২০১০ সালে ৩৮, ২০১১ সালে ৩৭, ২০১২ সালে ৩৪, ২০১৩ সালে ৩৫ ও ২০১৪ সালে ২৫ বার ভূমিকম্প অনূভূত হয়।

বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমার ত্রিদেশীয় অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বৈশিষ্ট্যানুসারে এর অবস্থানকে পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প বলয়ের মধ্যে ধরা হয়। বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূকম্পণপ্রবণ এলাকায় গত ১৫০ বছরে অন্তত ৭ থেকে ৮ মাত্রার ৭টি ভূমিকম্প ও একাধিক সুনামি হয়েছে যার মধ্যে দুটির উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং ৫টি খোদ রাজধানী থেকে মাত্র ২৫০ কিলোমিটার দূরে।

এদিকে জাতিসংঘ প্রণীত আর্থকোয়েক ডিজেস্টার ইনডেক্স অনুযায়ী পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভূমিকম্প-ঝুঁকিপ্রবণ ২০টি দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম। ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকার ৭২ হাজার ভবন গুঁড়িয়ে দিতে পারে এবং তাতে ৩ কোটি টনের ধ্বংসস্তূপ তৈরি হবে। এসবের মধ্যে সচিবালয়ের কিছু ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ও এর আশপাশের অঞ্চলে ভূমিকম্প হওয়ার মতো প্লট বাউন্ডারি বা ফাটলরেখা সক্রিয় রয়েছে, ফলে যে কোনো সময়ে দেশে ৮ থেকে ৯ মাত্রারও ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বঞ্চল অস্থির ভূ-স্তরের ওপর থাকায় এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষ করে ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান, ইউরেশীয় একাধিক ভূ-স্তর ফাটলের লাইন বিস্তৃত থাকায় এবং এর সঞ্চালনের ফলে বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের এলাকায় ভূমিকম্প বলয়টি বিশ্বের অন্যতম ক্রিয়াশীল বলে বিবেচিত।

এসব অঞ্চলের বারবার মৃদু, মাঝারি এবং কখনো এরও অধিক মাত্রার কম্পনের কারণে ভূ-ফাটলরেখাগুলো ক্রমশ শিথিল ও নাজুক রূপ নিচ্ছে যা আগামীতে ৭ থেকে ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। একই ধরনের ভূ-স্তরের ফাটলরেখার আওতায় পড়ায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ দেশের অন্যান্য স্থানও ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

এসব বিষয় বিবেচনায় এনে দেশজুড়ে ভবন মালিকদের বাড়িঘর নির্মাণ, নগর পরিকল্পনাবিদদের ডিজাইনে বিল্ডিং কোড সম্পূর্ণভাবে মেনে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণের সুপারিশ উঠে এসেছে বার বার।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, হাসপাতাল ও ফায়ার সার্ভিসসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে ভূমিকম্পপ্রতিরোধী করে গড়ে তোলা আবশ্যক। আর এ মুহূর্তে অধিক ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা বাসযোগ্য পুরনো ভবনগুলোকে দ্রুত রিট্রোফিটিং করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এই কাজের জন্য গণপূর্তের অধীনে একটি রিট্রোফিটিং সেল গঠনের পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

তবে এ মুহূর্তে আমাদের দেশে ভূমিকম্প পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলার ওপরই বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন নগরবিদরা।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলামেইলকে বলেন, ভূমিকম্প পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলায় এবং উদ্ধার তৎপরতা চালাতে হালকা ও ভারী সব ধরনের যন্ত্রপাতি সুসজ্জিত করে রাখা জরুরি। ভূমিকম্প সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষ ভূমিকম্প মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে অজ্ঞাত।

এ ছাড়া ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজে সাহায্যের জন্য পাড়ায়-পাড়ায় স্বেচ্ছসেবক দলও গঠন করা যেতে পারে। যারা সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস দলের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতে পারবে। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা জোরদারসহ ভূমিকম্প পূর্ববর্তী জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলায় সরকারকে যথেষ্ট প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান এই স্থপতি।

পাশাপাশি এ বিষয়ে জনসচেতনতা, সতর্কতা ও আত্মরক্ষামূলক কৌশল রপ্ত করার লক্ষ্যে দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোকে নিয়মিত প্রচার-প্রচারণা চালানোর পরামর্শও দেন তিনি।

ভূমিকম্প পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলায় কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ?

ভূমিকম্প দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ভূমিকম্পের সময়, ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে জনগণের করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার ও লিফলেট বিতরণ, বিলবোর্ড স্থাপন ইত্যাদি সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার অভিযানে সফল অংশগ্রহণের জন্য ৬২ হাজার আরবান সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ ভলান্টিয়ার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে এবং ইতোমধ্যে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

এ ছাড়া ভূমিকম্পে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য ১৫৮ কোটি টাকার মালামাল ক্রয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানিয়েছেন দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত, এক গবেষণানুযায়ী ভূমিকম্পের মাত্রা ৭-এর ওপরে উঠলে বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানীর পুরান ঢাকার স্থাপনাগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এবং ৭ থেকে ৮ মাত্রা রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার স্থাপনা। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় শহর। এছাড়া ঢাকায় রাতের বেলায় ৭.০ থেকে ৭.৫ তীব্রতার ভূমিকম্প হলে ৯০ হাজার মানুষ হতাহত হবে। দিনের বেলায় হলে এ সংখ্যা হতে পারে ৭০ হাজার।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৩,২৬,০০০ ভবনের ওপর চালানো এক সমীক্ষায় জানা যায়, এ ধরনের তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং প্রায় ৮৫ হাজার স্থাপনা মাঝারি ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। যে ধ্বংসযজ্ঞের শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

মন্তব্য